নজরুলের ১১৬তম জন্মদিন আজ

0

সোমবার, ২৫ মে, ১১ জৈষ্ঠ্য। ‘ধুমকেতু’র সঙ্গে তুলনীয় এই মহান কবির ১১৬তম জন্মদিন। কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের এই দিনে বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানাধীন চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। সে নামের সঙ্গে সুবিচার (!) করতেই হয়তো শৈশবে পিতৃহারা হন নজরুল। এরপর বাধার দুর্লংঘ্য পর্বত পাড়ি দিতে হয়েছিল তাকে। অতঃপর একদিন সকলকে চমকে দিয়ে বাংলার সাহিত্যাকাশে দোর্দন্ত প্রতাপে আÍপ্রকাশ করেন কবি। কবিরূপে নজরুলের এ অভ্যূদয় ধুমকেতুর সঙ্গেই তুলনীয় কেবল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পর্কে যথ্যাপিই বলেছেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/ আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’

চট্টগ্রামে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর ১১৬তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হবে।
প্রেম, দ্রোহ আর মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মানবানুভূতির এই ত্রয়ী বন্ধনের বাইরেও তার সৃজনে উঠে এসেছে বিপ্লব আর সাম্যের বাঁধনে মানবমুক্তির উদাত্ত আহ্বান। মানুষের চেতনায় আঘাত করে তাকে জাগিয়ে তোলার বিস্ময়কর ক্ষমতা লালন করতেন নজরুল। জ্যোতির্ময় অসম্প্রদায়িক এই কবির লেখনিতে বারবার উঠে এসেছে বাঙালির সকল মেধা-মনন ও অস্তিত্বের জগত। বাংলার সাহিত্য আকাশে বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুলের আবির্ভাবকে বলা যায় অগ্নিবীণা হাতে ধূমকেতুর মতো প্রকাশ।

তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্য তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সংগীত তথা গজল। নজরুল প্রায় তিনহাজার গান রচনা এবং সুর করেছেন; যা এখন নজরুল সংগীত নামে পরিচিত। মধ্যবয়সে তিনি পিক্স ডিজিজে আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। এক সময় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭২ সালে ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। এ সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। একই সালে কবির ছোট ছেলে ও বিখ্যাত গিটার বাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। এ বছরের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্র“য়ারি দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয় তাকে। তৎকালীন প্রধান আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে তার হাতে দিয়ে আসেন। সেখানেই কবির শেষ দিনগুলো কাটে। সে বছরের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তার কবিতাতেই বলে গিয়েছিলেন- ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই, যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই’। আর তাই এই ইচ্ছাকেই বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়ে তাকে সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে।

কাজী নজরুল ইসলাম দুই বাংলায় সমভাবে সমাদৃত। তার প্রসঙ্গে ওপার বাংলার কবি অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নিকো নজরুল/এই ভুল টুকু বেঁচে থাক/বাঙালি বলতে একজন আছে/দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক।’

১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারার সৃষ্টি করে। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে; ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’, ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ইত্যাদি। নজরুলের প্রথম গদ্য রচনা ছিল ‘বাউন্ডুলের আÍকাহিনী’। ১৯১৯ সালের মে মাসে এটি সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার লেখা অন্যান্য গদ্যের মধ্যে রয়েছে ‘হেনা’, ‘ব্যাথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়; যার নাম ‘ব্যথার দান’। এছাড়া একই বছর প্রবন্ধ-সংকলন ‘যুগবাণী’ও প্রকাশিত হয়।

নজরুলের সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য তার গান। তার লেখা গানগুলো ১০টি ভাগে বিভাজ্য ভক্তিমূলক গান, প্রণয়গীতি, প্রকৃতি বন্দনা, দেশাÍবোধক গান, রাগপ্রধান গান, হাসির গান, ব্যাঙ্গাÍক গান, সমবেত সঙ্গীত, রণ সঙ্গীত এবং বিদেশীসুরাশ্রিত গান। সীমিত কর্মজীবনে তিনি তিন হাজারেও অধিক গান রচনা করেছেন। পৃথিবীর কোনো ভাষায় একক হাতে এত বেশি সংখ্যক গান রচনার উদাহরণ নেই। এ সকল গানের বড় একটি অংশ তাঁরই সুরারোপিত। তাঁর রচিত ‘চল চল চল, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল’ বাংলাদেশের রণসঙ্গীত। তাঁর কিছু গান জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে গানের মালা, গুল বাগিচা, গীতি শতদল, বুলবুল ইত্যাদি। পরবর্তীকালে আরও গান সংগ্রন্থিত হয়েছে। তবে তিনি প্রায়শ তাৎক্ষণিকভাবে লিখতেন; একারণে অনুমান করা হয় প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের অভাবে বহু গান হারিয়ে গেছে। এছাড়া, কাজী নজরুল গান রচনাকালে ১৯টি রাগের সৃষ্টি করেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

কবি নজরুল ধ্যানে-জ্ঞানে, নিশ্বাসে-বিশ্বাসে, চিন্তাচেতনায় ছিলেন পুরোদস্তুর অসাম্প্রদায়িক। যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষে জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে, তখনই কবি ঘৃণাভরে তাদের প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণ করেছেন। কবিতার ভাষায় বলেছেনÑ ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল বৈশাখীর ঝড়।তোরা সব জয়ধ্বনি কর’।

বাণী ও কর্মসূচি
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। সরকারি-বেসরকারি চ্যানেলগুলো প্রচার করছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি রেডিও স্টেশনগুলো আয়োজন করেছে বিশেষ অনূষ্ঠানমালার।

জাতীয় পর্যায়ে কবি নজরুলের ১১৬তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। এ বছর জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে কুমিল্লায়। কুমিল্লার টাউনহল চত্বরে বিকাল ৪ টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, রেলমন্ত্রী মো: মুজিবুল হক, নজরুল ইন্সটিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি প্রফেসর এমিরিটাস রফিকুল ইসলাম উপস্থিত থাকবেন। নজরুল স্মারক বক্তা হিসেবে অধ্যাপক শান্তনু কায়সার উপস্থিত থাকবেন।

এদিন সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। কবির জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে নজরুল ইন্সটিটিউট আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।

 

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.