চট্টগ্রামে মুজিব আদর্শে ফেরা মনজুর আলমকে নিয়ে নানা হিসাব নিকাশ চলছে

0

জুবায়ের সিদ্দিকী : চট্টগ্রামের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত একটি নাম এম. মনজুর আলম। আমৃৃত্যু তাঁর পিতা ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। তিনি নিজেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে থেকে তিনবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। মাঝে অভিমান করে বিএনপিতে যোগ দিয়ে মেয়র পদে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবনের গুরু এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে পরাজিত করে মেয়রও হয়ে চমক দেখিয়েছিলেন। সর্বশেষ গত বছরের ২৮ এপ্রিল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিন নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির রাজনীতিকে বিদায় জানান তিনি। এক বছরের মধ্যে তাঁর তেমন রাজনৈতিক কর্মকান্ড দেখা যায়নি। যদিও সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্টানাদিতে উপস্থিত ছিলেন। সম্প্রতি তিনি আবার মিশে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সঙ্গে। সবার কাছে মিষ্টভাষী, সজ্জন হিসেবে পরিচিত এম.মনজুর আলম এ বছর নিজের প্রতিষ্টিত ’বঙ্গমাতা শেখ ফজিলতুন্নেছা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন’এর ব্যানারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪১তম শাহাদাত বার্ষিকী পানল করেছেন। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে দু:স্থদের মাঝে বস্ত্র ও খাবার বিতরন করেন। এ ছাড়া ১৫ আগষ্ট সকালে নগরীর উত্তর কাট্টলী বাগানবাড়িতে খতমে কোরআন, দোয়া, মিলাদ মাহফিল ও আলোচনা সভা অনুষ্টিত হয়। সাবেক মেয়র এম.মনজুর আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্টিত এ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তারই ভাতিজা আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মো: দিদারুল আলম। আকবর শাহ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোলতান চেয়ারম্যান, সাধারন সম্পাদক কাজী আলতাফ, সীতাকুন্ড উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন ছাবেরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল বাকের ভুঁইয়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অবশ্য এম. মনজুর আলম যখন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন, তখনও মেয়র হিসেবে তিনি ১৫ আগষ্ট শোক দিবস পালন করতেন। ব্যক্তিগত ফান্ডের টাকা দিয়ে পরিচালনা করতেন ’বঙ্গমাতা বেগম ফজিলতুন্নেছা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন’। এ নিয়ে তখন বিএনপির অনেক নেতা এম. মনজুর আলমের উপর ক্ষুদ্ধও ছিলেন।

১২ বছর আগে ’বঙ্গমাতা বেগম ফজিলুতন্নেছা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্টা করেছেন জানিয়ে এম. মনজুর আলম বলেন,’ আমি এই সংগঠনের ফাউন্ডার এবং নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। সভাপতি হিসেবে আছেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুকে মনেপ্রানে ধারন করেন উল্লেক করে এম.মনজুর আলম বলেন, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলতুন্নেছাকে আমার মায়ের মর্যাদা দিয়েছি। আগামী প্রজন্মও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করবে। আগামী বছর থেকে ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ঢাকায় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলতুন্নেছার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হবে বলেও জানান তিনি। পিতা থেকে পরবর্তী চতুর্থ প্রজন্ম পর্যন্ত সবাই বঙ্গবন্ধু আদর্শে উদ্বুদ্ধ বলে জানান এম. মনজুর আলম। তিনি বলেন,’ আমার বাবা আমৃত্যু আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। আমিও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছি। দলের হয়েই কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছি। বর্তমানে আমার ভাতিজা সংসদ সদস্য। আমার ১১ বছরের এক নাতি শেখ রাসেল জাতীয় শোক দিবস উদযাপন পরিষদের আহবায়ক। আমাদের পুরো পরিবার আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী। ফের আওয়ামী লীগে ফিরেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,’ফিরে আসা নয়, আমি যেখানে গিয়েছি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারন করেছি। বিএনপির মেয়র থাকা অবস্থায়ও জাতীয় শোক দিবস পালন করেছি। বঙ্গবন্ধুকে সম্মানের ক্ষেত্রে কোন কার্পন্য ছিল না। কারন রাজনীতি আলাদা বিষয়, বঙ্গবন্ধু সবার উধ্বে। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এম. মনজুর আলমের বাবা আবদুল হাকিম কন্ট্রাক্টর স্বাধীনতার আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমৃত্যু ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য। নিজের অবস্থান থেকে দলের জন্য কাজ করে গেছেন। নগরে আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে নিতে তার গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা ছিল, আজও স্মরন করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। প্রয়াত আবদুল হাকিম কন্ট্রাক্টরের মৃত্যুবার্ষিকীতে উপস্থিত থাকেন নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। গত ১০ জুন অনুষ্টিত ২০তম মৃত্যুবাষিকীতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।

জানা যায়, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক মেয়র এম. মনজুর আলম। তৎকালীন মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিশ্বস্থ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে অন্তত ১৮ বার পালন করেছেন ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব। ওয়ান ইলেভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মাহিউদ্দিন চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হলে টানা দুই বছর ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন মনজুর আলম। ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ২০১০ সালের চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দল থেকে মেয়র প্রার্থীর মনোনয়ন চান তিনি। কিন্তু এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে দলীয় প্রার্থী ঘোষনা করা হয়। তখন প্রার্থীশুন্য বিএনপি এম.মনজুর আলমকে তাদের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে চমক দেখান। এ বিষয়টিকে সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির হেভিওয়েট নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী,’রবীন্দ্রনাথের জুতা আবিস্কারের মত’ বলে উল্লেখ করেন। প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে শিষ্য মনজুর আলমের কাছে পরাজিত হন তিনবারের মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। নির্বাচিত হওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করেন মনজুর আলম। এর পর তাকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করা হয়। মেয়র হিসেবে ভাল মানুষ পরিচিতি পেলেও দলীয় কর্মকান্ডে সক্রিয় না থাকায় তাকে নিয়ে বিএনপিতে ছিল অসন্তোষ। তবে পাঁচ বছরে দলে আর্থিক সহায়তা দিয়ে গেছেন মনজুর আলম। এরপরও তাকে বিএনপি নেতাদের নানা ধরনের অভিযোগ-অনুযোগ ও কটুক্তি শুনতে হয়েছে নিয়মিত। ফলে একদিকে রক্তে মিশে থাকা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের নেতিবাচক মনোভাবে মনজুর আলমের কাছে রাজনীতি হয়ে উঠে বিরক্তের কারন। দলের জন্য অনেক কিছু করেও প্রশংসা না পাওয়ায় কষ্ট পান তিনি। এরপরও ২০১৫ সালের মেয়র নির্বাচনে দল থেকে প্রার্থী করা হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু নির্বাচনে প্রতি পদে পদে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে তাকে এবং তার পরিবারকে। অপরদিকে নির্বাচনের মাঠে মনজুর আলমকে নামিয়ে গিয়ে বিএনপি নেতাদের অনেকে তামাশা দেখতে থাকেন। চট্টগ্রামে বিএনপি নেতাদের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং এর খেসারত দিতে হয়েছে তাকে আর্থিক ও মানসিকভাবে। এ অবস্থায় নির্বাচনের দিন সুকৌশলে ১১ টার দিন তিনি নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি রাজনীতি থেকে সরে দাড়ান। এ সময় তিনি ভারাক্রান্ত মন ও অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়লেও রাজনীতি ছাড়ার কারন ব্যাখ্যা করেননি। আবার রাজনৈতিক গুরু এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে পরাজিত করে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র হলেও মনজুর আলম বরাবরই মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। এমনকি মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেওয়া সিদ্ধান্তকে কোন অবমুল্যায়ন করেননি। বিশ্বস্থ মানুষগুলো দুরে সরে যাওয়ায় মহিউদ্দিন চৌধুরী কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে মনে করেন তাঁরই শিষ্য এম.মনজুর আলম। তবে তার মতে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন চৌধুরীর কোন বিকল্প নেতা নেই। মহিউদ্দিন চৌধুরী সম্পর্কে মনজুর আলম বলেন, উনি অনেক সময় রেগে কথা বলেন। কিন্তু মানুষকে অত্যন্ত ভালবাসেন। বকা দিলেও যে কোন কাজ তিনি করে দেন। সারাজীবন কেবল মানুষের উপকারই করেছেন। উনার মত দেশ প্রেমিক দ্বিতীয় কোন রাজনীতিবিদ চট্টগ্রামে নেই। এদিকে এম.মনজুর আলমের দলে ফেরা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকবর্গ মনে করেন,’হাইকমান্ডের ইংগিত ছাড়া মনজুর আলমের মত প্রভাবশালী নেতা দলে ফেরার কথা নয়। তাদের মতে,’ আগামী সংসদ নির্বাচনে নগরীর যে কোন আসনে মনজুর আলমকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হলে আশ্চর্যের কিছুই থাকবে না। এ ক্ষেত্রে নগরীর বিভিন্ন আসন থেকে নির্বাচিত যে কোন একজনের বাজতে পারে বিদায় ঘন্টা! মনজুর প্রস্থানকে তেমন কিছুর পুর্বাভাস হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.