শরতের শুরুতে চন্দনাইশে কাশফুলের সমারোহ

0

মো. দেলোয়ার হোসেন, চন্দনাইশ : শ্রাবণের আকাশ বর্ষার কালো মেঘে ঢাকা। কখনো অবিরাম বৃষ্টি, কখনো বা থেমে থেমে বৃষ্টি, কখনো ঝমঝমিয়ে একেবারে ছালফাটা বৃষ্টি। শ্রাবণ শেষে ভাদ্র মাসের শুরুতে তথা শরতের আগমনে বর্ষা ঋতুকে বিদায় জানিয়ে প্রকৃতি বরণ করেছে শরৎকালকে। কিন্তু শরতের যে অনাবিল রূপ-মাধুরী, তা আজ অনেকটা উধাও। প্রকৃতিতে আজ নেই সুনীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা। ধানের ক্ষেতে নেই রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরির খেলা, নেই গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি। শরৎকাল এবার এসেছে বর্ষার মেঘ মেদুর জলে ¯œাত হয়ে। কবির মত তাই শরতের বন্দনা করে বলতে পারছি না। ‘আজ কি তোমার মধুর মুরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে/হে মাতঃ বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ ঝুলিছে অমল শোভাতে’।

ঋতুচক্রের আবর্তে ভাদ্র আর আশ্বিন এ দুইমাস শরৎকাল। আষাঢ়-শ্রাবণ দুইমাস ব্যাপী বর্ষার ভরা বাদলের মাদল বাজানো শেষে প্রকৃতিতে শরতের আগমন ঘটে। বর্ষার বারিধারায় মানুষ আর প্রকৃতি যখন সবুজ আর সজিব হয়ে উঠে, এ সবুজের আবহ ভেঙ্গে গণঘোর বরিষন্নোত হতে হতেই এক সময়ে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা উড়িয়ে শরৎ আসে। বর্ষণসিক্ত প্রকৃতি তখন সাজে অনেকরূপে। শুরু হয় প্রকৃতিতে রোদ আর বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা। ঝকঝকে রোদেলা আকাশ থেকে হঠাৎ মেঘের ঝমরু বাজিয়ে বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে। তা আবার বর্ষার মত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যেখানে মেঘ সেখানে বৃষ্টি, তা ক্ষণিকের জন্য। ফলে একটু পরেই আবার আকাশ হয়ে যায় ঝকঝকে পরিষ্কার। সুনীল আকাশে তখন মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায় পেঁজা তুলার মত ছুটতে থাকে এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। গাছের সবুজ পাতার ফাঁকে ঝিকমিক করে সোনালী রুদ্র। বনে বনে ফুটে শরতের প্রধান অনুসঙ্গ কাশফুল। প্রকৃতির এ অনাবিল সৌন্দর্য্য নগর জীবনে আস্বাদনের কোন উপায় নেই। তাই এই সৌন্দর্য্য উপভোগের জন্য ছুটতে হয় ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নিড় ছোট কোন গ্রামে। যা দেখা যাচ্ছে চন্দনাইশের বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, দোহাজারী দেওয়ানহাট সংলগ্ন নৌ-পরিবহন আভ্যন্তরীন কেন্দ্রে, শঙ্খনদীর উভয় পাড়ে, পটিয়ার ভাইয়ের দীঘি সংলগ্ন খালের পাড়ে, পটিয়া পৌরসভা বাস ষ্টেশন সংলগ্ন এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে বিভিন্ন এলাকায় ফুটে আছে সাদা সাদা কাশফুল। এ দৃশ্য সবার নজর কাড়ে। গ্রামের বিলের ধারে উড়ে বেড়াবে সাদা বক ছকছক করে। অদূরে বালুচরে কাশবন, কিশোরীর আঁচল উড়িয়ে ডাকবে হাতছানি দিয়ে। সেখানে যেতে হবে শিশির ভেজা দূর্বা মাড়িয়ে, লজ্জাবতীর মায়াবী পরশ ডিঙিয়ে। নদীতীরে বাঁধা থাকবে তরণী, তরণী বেয়ে যে যার ইচ্ছামত ছুটবে মুক্তবিহঙ্গ হয়ে। এ সময়ে ঝিলেবিলে শুরু হয় মাছ ধরার উৎসব। আবার শাপলা আর শালুকের খুঁজে বিলে বিলে ঘুরে বেড়ায় কিশোরী তরুণীর দল। গাছে গাছে ফুটে বেলী, শিউলী, হাসনাহেনা, কামিনী, গন্ধরাজ। মধুকর, ঘাসফুড়িং, প্রজাপতি আর নানা জাতের পাখ আর পাখালির কলকাকলিতে প্রকৃতি পায় অন্য রকম এক প্রাণময়তা। গৃহস্থীর বাড়ীতে গৃহিনী ব্যস্ত হয়ে পড়ে এ সময়ে। চলে পিঠাপুলির উৎসব। পাকা তালের মৌ মৌ ঘ্রাণে জিহবে জল আসে অনেকের। বর্ষার নিবিড় জলে ¯œানরত। শরতের সত্যিকারের রূপ-মাধুরী কখন আমরা দেখতে পাব জানি না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন টলে উঠেছে পরিবেশের ভারসাম্য। এ কারণে প্রকৃতি এখন বৈরী হয়ে উঠেছে। কখনো অতি বৃষ্টি, কখনো অনাবৃষ্টি কিংবা প্রচন্ড খরা আর তীব্র তাপদাহের কবলে পড়ে আমরা হাসপাস করতে থাকি। এ অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে আমাদেরকে মুক্তি পেতে হবে, প্রকৃতির প্রতি অন্যায় বা বৈরী আচরণ বন্ধ করতে হবে, প্রকৃতি যে সহজাত সম্পদ তা রক্ষা করতে হবে, পাহাড় না কেটে, গাছ-পালা, বন-জঙ্গল ধ্বংস না করে যা যেভাবে ছিল, সেভাবে রেখে দিতে হবে। তবে আর বন্যহাতির দল ধেয়ে আসবে না লোকালয়ে। জীবজন্তু আর পশু-পাখি হারাবেনা তাদের বেঁচে থাকার আশ্রয়স্থল। ঘণ বনের আড়ালে, আবডালে তখন আপন সূরে শিষ দিয়ে উঠবে বনমুরগটি। ছোট কাঠবিড়ালী ও হিক করে হেঁসে দৌড় দেবে আপনালয়ে। এ ঋতুবৈচিত্র্য, বাঙ্গালী, বাঙ্গালী সাহিত্যের লেখকদের খোরাক ছিল। যা এখন আমরা হারাতে বসেছি।
শরৎ ঋতুর সাথে কাশফুলের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। আকাশে সাদা মেঘের উড়াউড়ি আর কাশফুলের ঢেউ খেলানো সৌন্দর্য্য দেখলেই বুঝা যায়, শারদীয় উৎসব সমাগত। এদেশের নদীর পাড়, পাহাড় ভুমি, চরাঞ্চল, অব্যবহৃত জমি এক কথায় বলা যায়, সুযোগ পেলেই কাশের ঝাড় বেড়ে উঠে। প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চলের মানুষেরা মাঠে-ঘাটে কাশফুলের মনভুলানো পাহাড় দেখে আসছে। তার বর্ণনা কালীদাসসহ অনেকের কাছে পাওয়া যায়। বর্তমান বিশ্বে ঘাস প্রজাতির ৬শ বনে দশ হাজার প্রজাপতি আছে। তার মধ্যে প্রায় ৪শ প্রজাপতি আছে আমাদের দেশে। কাশের আরো কিছু পরিচিতি জাতভাই হচ্ছে কুশ ও গুড়িঘাস। কুশ সাধারণত উষ্ণ ও মরু অঞ্চলে জন্মে।
ভারতের গয়া ও দ্বারভাঙ্গা জেলার কোশীনদীর দ্বারে কুশ প্রচুর জন্মে। এ জন্যেই এ নদীর নাম কোশী। আধুনিক কালের কুশপুত্তলিকা দাহ এ কুশ থেকে উৎপত্তি বলে জানা যায়। প্রাচীন কালে কোন অপঘাতে মৃত্যু কিংবা কোন ব্যক্তি নিখোঁজ হলে কুশগুচ্ছ দিয়ে মানুষ আকৃতির মূর্তি বানিয়ে তাকে দাহ করা হতো। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন এভাবে পারলৌকিক দানধর্ম সম্পাদন করে থাকত। বর্তমান যুগে কুশপুত্তলিকার দাহ প্রতিবাদ জানানোর ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
শরতের আগমনে কাশফুল ফুটে, ঘাসের দ্বার থেকে তা চেনা যায় এ কাশফুল। বাংলা সাহিত্যে কাশবনের বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। যদিও আধুনিক এ নাগরিক সমাজে কাশফুল দেখার সুযোগ কম। তবে গ্রামীণ এলাকায় এখনো কাশফুলের বাহার চোখে পড়ার মত। আকাশে সাদা মেঘের উড়াউড়ি আর মাঝে মাঝে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ফলে মেঘ হালকা হয়ে আরো সাদা হয়ে যায়। তার ছায়া পড়ে নদীর দ্বারে কাশবনে। কাশবনের এরূপ মাধুর্য্য শুধু বাঙালী নয়, যেকোন মানুষকে অভিভুত করে তুলবে। সাদা মেঘ, নীল আকাশ, সাদা ফুলের অপার সৌন্দর্য্য ঘুমপাড়ানি গানের মত শান্ত মধুর। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীরা আজ নানা কারণে হারিয়ে যাওয়ার পথে। তারপরও নদী ও কাশফুল যেন একচ্ছত্রে বাঁধা। নদীর বর্ণনা দিতে গেলে তার প্রাকৃতিক অবস্থানের কথা এলেই কাশবনের বর্ণনা দিতে হয়। শরৎকালীন ফুল, রং সাদা, তবে গুড়ি ঘাসের ফুলের রং হালকা বাদামী। কাশফুলের মঞ্জুরী দন্ড ১৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার লম্ব হয়ে থাকে, বীজে সুক্ষ্ম সাদা লুম থাকে। কাশের মুলায়েম পাপড়ী বাতাসে উড়ে বেড়ায়। যা দেখে অপূর্ব লাগে। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় এ ছোট ছোট পাপড়ী বা বীজ নাকে প্রবেশ করলে ফুস ফুস প্রদাহ বা কাশি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ মহল অভিমত ব্যক্ত করেন। কাশ উদ্ভিদ প্রজাতির, উচ্চতায় তিন মিটার থেকে পনের মিটার লম্বা হয়ে থাকে। আর এর শেকড় গুচ্ছমূল থাকে। পাতা রুক্ষ্ম ও সোজা দেখার মত। শারদীয় উৎসবের প্রারম্ভে আমাদের হৃদয় পুতঃ পবিত্র হউক।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.