চন্দনাইশে শিশু মৃত্যু বাড়ছে পানিতে ডুবে

0

মো. দেলোয়ার হোসেন, চন্দনাইশ : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ১ থেকে ৯ বছর বয়সের মধ্যে শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মারা যায় ১ থেকে ৪ বছর বয়সী শিশুরা। চন্দনাইশে গত ৩ মাসে ৯ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।
২৩ এপ্রিল ধোপাছড়ির চিড়িংঘাটায় এনামুল হকের মেয়ে লুৎফুন্নেছা (৪), ১১ মে সাতবাড়ীয়ার বেপারী পাড়ার তপন বড়ুয়ার ছেলে সীমান্ত বড়ুয়া (৮), ১৪ জুন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাছির উদ্দিনের একমাত্র ছেলে নামিন (৭), ২০ জুন বৈলতলীতে হাছি মিয়ার স্ত্রী ফাহিমা বেগম (৫৫) পানিতে পড়ে মারা যায়, ২১ জুন উত্তর হারলার প্রবাসী নেজাম উদ্দিনের মেয়ে নাফিসা (২) পানিতে ডুবে মারা যায়, ২৬ জুন সাতবাড়ীয়া হাছনদন্ডীর কোরবান আলীর মেয়ে রুমা আক্তার (৮), ২৫ জুন শঙ্খনদীতে গোসল করতে নেমে আমিনের মেয়ে রোজিনা আক্তার (১২), ২৮ জুন বৈলতলী জাফরাবাদের আবদুস শুক্কুরের দেড় বছরের মেয়ে তানহা পানিতে ডুবে মারা যায়। এভাবে প্রতি বছর প্রতি মাসেই দু’একজন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।
পুুকুরে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক। এ ধরনের মৃত্যুরোধে শিশু ও অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। আশে পাশে পুকুর, জলাশয়ের ব্যাপারে সতর্ক নজরদারী বাড়াতে হবে। তাহলে পুকুরে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমবে। উপজেলায় প্রতি বছর যেসব শিশু নানা কারণে মৃত্যুবরণ করে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই পানিতে ডুবে মারা যায়। দিন দিন শিশু মৃত্যুর হার এভাবে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় অভিভাবকের উদ্বিগ্ন। সরকারি জরিপের হিসাব অনুযায়ী বছরে ১২ হাজারের অধিক শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। সে জরিপ অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে অনুর্ধ্ব-১৮ বছর বয়সী ৪৬ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। এতে প্রায় বছরে সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭ হাজার। এদের বেশির ভাগই শিশুর বয়স ১০ বছরের নিচে। উচ্চহারে এ মৃত্যুকে মহামারীর পর্যায়ে গণ্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। গ্রামাঞ্চলে এর ঝুঁকি শহরের চেয়ে অনেক বেশি।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) সূত্রে জানা যায়, থানা হাসপাতাল পর্যন্ত পৌছায় না বলে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর অনেক ঘটনা জানা যায় না। সরকারের স্বাস্থ্যনীতিতে শিশু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ৫টি সমস্যার মধ্যে এটি একটি। যদিও অনেক শিশু পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার বিষয়টি বরাবরই আছে। এটাকে এ যাবৎ শিশু মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি এবং গুরুত্বও দেয়া হয়নি। শুধু মৃত্যু নয়, বছরে ৬৮ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মরতে মরতে বেঁচে আসে। সেটাও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য কম হুমকির বিষয় নয়। গবেষকেরা বলেছেন, ১০টি মারাত্মক রোগের টিকাদান, ডায়রিয়া প্রতিরোধ, মায়ের দুধ খাওয়ানো ইত্যাদি বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। এখন শিশু মৃত্যুর বড় কারণ রয়ে যাচ্ছে নানা ধরনের দুর্ঘটনা, বিশেষ করে পানিতে ডোবা। আগে শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি। সেগুলো নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় কারণ পানিতে ডুবে শিশু মারা যাওয়া। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশেই পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি।
২০০৫ সালের এক জরিপে জানা যায়, ৪ বছর বয়সী যত শিশু মারা গেছে এর ৪৯ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে। তাই বিশেষজ্ঞরা শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আইসিডিডিআরবি। তারা আরও বলেছেন, ১৯৭৪ সাল থেকে শুরু করে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে শিশু মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। এরপর থেকে ধনুষ্টংকের মৃত্যুহার কমতে থাকে। ১৯৯১ সালের পর তা প্রায়ই অনুপস্থিত। ১৯৮৩ সালে পানিতে ডুবে মৃত্যু ছিল ১ থেকে ৪ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ৯ শতাংশ। ২০০০ সাল নাগাদ ৫৩ শতাংশে দাঁড়ায়। সার্বিকভাবে আঘাত এবং দুর্ঘটনাজনিত কারণে বছরে ৩০ হাজারের বেশি অনুর্ধ্ব-১৮ বছর বয়সী শিশু বেশি মারা যায়। এ বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার ৩৮ শতাংশ ঘটে এ সকল কারণে।
২০০৫ সালে প্রকাশিত বিএসআইএস’র এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আঘাত, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর অর্ধেকেরই বেশি বছরে ১৭ হাজার মৃত্যু ঘটেছে পানিতে ডুবে। পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ১ থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে। এ শিশুদের মৃত্যুর অন্যান্য কারণ হচ্ছে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, অপুষ্টি ইত্যাদি।
এক গবেষণায় জানা যায়, ৪ বছর বয়সী যত শিশু মারা যায়, তার ২৬.৫ শতাংশের মৃত্যুর কারণ পানিতে ডুবে, ২৩ শতাংশ নিউমোনিয়ায়, ১০ শতাংশ ডায়রিয়ায়। অপুষ্টি ও বয়সে মৃত্যুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ। ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ পানিতে ডোবা। এ সম্পর্কে সচেতনতা কম বলে উল্লেখ করেছেন তারা। পানিতে ডোবা শিশু মৃত্যুর হিসাব থানা প্রশাসনের কাছে থাকে না। এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে ধরে নেয় মানুষ। হাসপাতালেও এর তেমন কোন হিসাব পাওয়া যায় না। পানির নিচে তলিয়ে গেলে সাধারণত তিন মিনিটের মধ্যে শিশু মারা যায়। বাড়ীর পাশের পুকুরে বা ডোবায় ডুবে শিশু মারা গেলে সে সম্পর্কে জানার উপায় থাকে না। অথচ প্রতিটি মানুষের পরিচিতজনদের কারো না কারো শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। এমনকি গ্রামে গরুর পানি খাওয়ার বড় পাত্রে পড়েও অনেক শিশু মারা যায়। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার দেশের সব অঞ্চলে রয়েছে।
গবেষকেরা বলেছেন, এক বছর বয়সের শিশুরা যখন হাটতে শুরু করে তখনই ঝুঁকি বাড়তে থাকে।
বিএইচআইএস’র গবেষণায় দেখা যায়, পানিতে ডুবে মারা যাওয়া তিন চতুর্থাংশের শিশু বাড়ী থেকে মাত্র ২০ মিটারের মধ্যে ছিল দুর্ঘটনার জলাশয়। শহরের চেয়ে গ্রামে পানিতে ডুবে শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। দিনের বেলা রান্নাবান্না ও সংসারের কাজে মায়েরা যখন ব্যস্ত, তখনই এ দুর্ঘটনা ঘটে। ইউনিসেফ এর তথ্য অনুযায়ী যেসব শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়, এদের ৯০ শতাংশ শিশু প্রত্যেকেই টিকা পেয়ে থাকে। কিছু শিশু স্কুলে যেতে শুরু করে। এ মৃত্যু টেকানো গেলে একদিকে যেমন শিশুর জীবন বাঁচবে, তেমনি দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগ বিফলে যাবে না। সরকারের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মসূচি (এইচএমপিএসপি) শৈশবে রোগ-ভোগ সংক্রান্ত কার্যক্রমে ৫টি বিষয়কে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার একটি। ফলে শিশুদের সাঁতার শেখানো, সচেতনতা কর্মসূচি, কর্মশালা, মায়েদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। ইউনিসেফ এর সহায়তায় সরকার ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন এসব কাজ করার কথা রয়েছে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.