আওয়ামীলীগের বিষ পোড়া উপড়ে ফেলা হোক

0

এসএম মনসুর নাদিম

আওয়ামীলীগের নবনির্বাচিত সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্পষ্ট কথা বলার জন্য সকল মহলে সুপরিচিত। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করা এই নেতার সঠিক সময়ে উচিৎ কথা বলতে কখনো কণ্ঠ কাঁপতে দেখিনি। ১১ নভেম্বর শুক্রুবার রাতে চট্টগ্রাম এসে সাবেক মেয়র এম মনজুর আলমের পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। পরদিন লালদীঘির মাঠে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া চট্টগ্রামের নেতাদের সংবর্ধনা উপলক্ষে আয়োজিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। সেখানেও তিনি সাধারন মানুষের মনের কথাটাই বলে গেছেন। তিনি বলেছেন-‘বসন্তের কোকিলরা দল ছাড়ুন’। ইতোপুর্বে সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকা ও আরও কয়েকটি অনলাইন পোর্টালে ‘বসন্তের কোকিল আর অতিথি পাখিদের ঠায় হবেনা আওয়ামীলীগে’ এই শিরোনামে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম আওয়ামীলীগ নেতা ওবায়দুল কাদেরের মুখেও একই কথার প্রতিধ্বনি শুনে প্রত্যাশা ও সাহস আরও বেড়ে গেল। ওবায়দুল কাদের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে বলেছিলেন-এ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করলে ডিসিপ্লিনারি শাস্তি পেতে হবে। এর সঙ্গে কোন আপস নেই’। সম্মেলনের ছয়মাস আগে থেকেই তিনি জানতেন যে, তিনি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দলের সাধারন সম্পাদক হবেন। এতো বড় একটি প্রাপ্তির সংবাদে উচ্ছাস থাকলেও তিনি তা প্রকাশ করেননি। ঘুনাক্ষরেও কাওকে বুঝতে দেননি। এবং সম্মেলন নিয়েও কোন টেনশন করেননি। রাজপথ কাঁপানো সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতার কাছ থেকে আজকের ছাত্রলীগ নেতাদের অনেককিছু শেখার আছে বলে আমি মনে করি। ১২ নভেম্বর প্রেস ক্লাবের ভি আই পি লাউঞ্জে সাংবাদিকদের সাথে আড্ডায় ওবায়দুল কাদের বলেন- তিনি চাপে রয়েছেন। দলকে শৃংখলায় আনার চাপ। সড়ক পরিবহনে যেমন শৃঙ্খলা নেই তেমনি ভাবে দলেও শৃঙ্খলা নেই। দলে শৃঙ্খলা আনা কঠিন কাজ। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধ থাকলেও তৃনমুলে কিছু সমস্যা রয়েছে। বিচক্ষণ এই নেতা মনে করেন, নেত্রীর ইচ্ছায় এই শৃঙ্খলা আনার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।
তৃনমুলে যে সমস্যা আছে সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন, উপলব্ধি করেছেন এবং নির্ভিক উচ্চারণ করেছেন। তিনি দেখেছেন তাঁর উপস্থিতিতে কীভাবে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে আওয়ামীলীগের দুই গ্রুপের হাতাহাতি। চট্টগ্রাম দক্ষিন জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী ও পটিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি রাশেদ মনোয়ারের অনুসারীদের মধ্যে এই বিতণ্ডার সময় মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দোতলার একটি কক্ষে ছিলেন। পরে মন্ত্রী নীচ তলায় নামার পরও দুইপক্ষ পরস্পরের উদ্দেশ্যে গালিগালাজ করে বলে প্রত্যক্ষ দর্শীরা জানান। এরকম অনেক ঘটনার সাক্ষী সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। অভিজ্ঞতাও প্রচুর অর্জন করেছেন। তাই এবার দেখার বিষয় ঝড়ের কবল থেকে নৌকার নিরাপদ যাত্রায় মাঝির দক্ষতা। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে চাটার দল আর খয়েরখাঁ দের দৌরাত্ব বেড়ে যায়।এটা বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে দেখা গেছে। দুঃসময়ে খয়ের খাঁ আর চাটার দলকে বাতি দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায়না। এক এগারোর সময় আওয়ামীলীগের প্রকৃত বন্ধুদের চেনা গেছে। বিজ্ঞ শেখ হাসিনা তাদের পুরস্কৃত করেছেন। দলের জন্য জীবনবাজি রাখবে যারা তারাই ক্ষমতার স্বাদ পাবে। ১৪ নভেম্বরের সুপ্রভাত বাংলাদেশ’র প্রথম পাতার একটি শিরোনাম ছিল-‘মাদক ব্যাবসা নিয়ে টিনুর অনুসারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া’। বিস্তারিত সংবাদে জানতে পারলাম, টিনু স্থানীয় যুবলীগ নেতা। ইতোপুর্বে ইয়াবা ব্যাবসার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে সাজা প্রাপ্ত হন আওয়ামীলীগের সাংসদ বদি। এখন সাধারনের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে রাজনীতি মানে কী মাদক ব্যাবসা ?সরকার মাদক নিষিদ্ধ করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় মাদক বিরোধী অভিযান চালিয়ে থাকে। মাদক বিক্রয়, মাদক পাচার ও মাদক সেবন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সমাজপতিরা, জনপ্রতিনিধিরা দেশ এবং জাতির স্বার্থরক্ষার শপথ নিয়েছেন। শপথ নিয়ে কোন জনপ্রতিনিধি যদি শপথ ভঙ্গ করেন তবে তিনি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেন। একটি ঐতিহ্যবাহী দলের ভাবমুর্তি গুটি কয়েক মাতাল, সন্ত্রাসী খুনির হাতে জিম্মি হতে দেয়া যায়না। সরকারের অর্জনকে ধুলিস্যাৎ করা যায়না।এক সময় সাধারন মানুষ ফিস ফিসিয়ে বলতো- ” জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমান, হাজী সেলিমরা আওয়ামীলীগের বিষপোড়া।
এখন আর কেউ ঐ কথা বলেনা।
এখন বলে- বদি, টিনু’র ইয়াবা সাম্রাজ্যের কথা।
মাদকের অর্থেও নেশা আছে। যারা এই অর্থ খেয়েছে তারা চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছে। দলের সুনাম সুনামিতে ভেসে যাক। নিজদের বাপ-দাদার নামটি যেন ডুবে না যায়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আওয়ামীলীগের প্রবীন নেতারা যদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ বাদ দিয়ে ঐক্যতার সুতায় নিজেদের বেঁধে নেন, তবে গ্রুপিং চিরতরে শেষ হয়ে যেতে বাধ্য। স্মরন রাখতে হবে আগে নিজেদের মাঝে ঐক্যতা সুদৃঢ করতে হবে। নজর রাখতে হবে সেইসব নেতাদের প্রতি যারা সরকারের ভেতর সরকার বনে বসতে চায়। চর দখলের মতো এলাকা দখল করতে চায়। নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সংগ্রামে জিঘাংসার লেলিহান শিখায় তপ্ত করে তোলে জনজীবনের প্রতিটি বিশুদ্ধ শান্ত মুহুর্তকে।
কেন্দ্র ঠিক চললেও তৃণমূলে কেন এই বিভাজন ? এই বিভাজন রাজনৈতিক আদর্শগত বিভাজন না। নয় কোন মতাদর্শের দ্বন্ধ। তবে কিসের বিভাজন ? এই বিভাজন কিসের তা আমি, আপনি সবাই জানি। কিন্তু বলা যাবেনা। কারন কার ঘাড়ে দুটো মাথা আছে’যে এদের চাপাতির সামনে ঠোঁট ফাঁক করে ? আমি বার বার বলি, যেখানে স্বার্থ, সেখানে সংঘাত। স্বার্থপরেরা দলের নাম ভাঙিয়ে নির্লজ্জভাবে নিজ স্বার্থ উদ্ধারে খুনো-খুনিতে লিপ্ত হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাঝে চট্টগ্রাম বন্দর হল সুলতান সুলায়মানের সিংহাসন। কর্তৃত্ব নিয়ে নীরব ষড়যন্ত্র, কাড়াকাড়ি, কাদা ছোঁড়াছুড়ি, টানাটানি, হানাহানি বন্দরের সেই জন্মলগ্ন থেকেই। একটি গল্প বলার লোভ সংবরন করতে পারছিনা। গল্পটা হল-একদা তিন জন হুজুরের খাবার দাওয়াত পড়লো একই বাড়িতে। বাড়ির মালিক বড় একটা থালায় তিন জনকে একসাথে খেতে দিলো। থালায় ভর্তি ছিল বিরিয়ানি। বিরিয়ানির ঠিক মাঝখানে খানিকটা গর্ত করে সেখানে অল্প ঘী ঢেলে দেয়া হয়। থালা যখন সামনে এলো, বড় হুজুর দেখলেন মাঝখানে ঘী। হুজুর কীভাবে ঘী পেতে পারে সেই বুদ্ধি করলো। হুজুর ওয়াজের সুরে বললেন- ভাইয়েরা আমার রোজ কেয়ামতের ময়দানে আল্লার সামনে নেকি-বদি সব এক কাতারে খাড়া হয়ে যাবে। বলেই আঙুল দিয়ে ঘী এর গর্ত থেকে সোজা নিজের দিকে একটা রেখা টেনে দিলো। এখন ঘী ধীরে ধীরে তার দিকে গড়িয়ে গড়িয়ে আসতে লাগলো। দ্বিতীয় হুজুর ওর চালাকি বুঝতে পেরে বললেন- নানা ভাই, একথা ঠিক না। রোজ কেয়ামতের দিন নেকি আর বদি দুইটি লাইন হবে বলে অনুরূপ ভাবে আঙুল দিয়ে আরেকটি রেখা ঘী’র থেকে নিজের দিকে টেনে দিলেন। তখন দুই হুজুরের কাণ্ড দেখে ছোট হুজুর এর রাগ এলো। তিনি বললেন- না না , এই কথা গুলি ঠিক না। আমি কেতাবে পড়েছি। রোজ কেয়ামতের দিনে ইয়া নাফসি ইয়া নাফসির আলম হবে। কোন লাইন-টাইন হবেনা নেকি-বদি সব মিক্স হয়ে যাবে। এই বলে তিনি বিরিয়ানির সাথে ঘী মিশিয়ে দিলেন। কিছু কিছু হুজুরেরা নিজেদের স্বার্থের জন্য মনগড়া ফতোয়া দিয়ে থাকেন। বন্দর নিয়েও আমাদের রাজনীতিবিদদের নানা ফতোয়া। নানা বক্তব্য। তারা তাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি এখনো। এলাকা দখল, ফুটপাত দখল শুধুমাত্র চাঁদাবাজির স্বার্থে হচ্ছে বড় বড় নেতাদের পোষ্য পাতি নেতা ও তাদের সেলফি ভক্তদের দ্বারা। মানুষ ভয়ে মুখ না খুললেও সরকারের ওপর বিরক্তি বাড়ছে এবং নিঃসন্দেহে আওয়ামীলীগের ভোটের ব্যারোমিটার নীচের দিকে নামছে। আগামীতে আওয়ামীলীগ যেখানে খুশি যাক, কিন্তু আজকের মওসুমি পাখিরা ঠিকই সেই সবুজ গাছে বসে নতুন মওসুমের গানই গাইবে। তাই আওয়ামীলীগের নবনির্বাচিত সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিকট আমাদের প্রত্যাশা, দলের কোন্দল ও দলে বিভাজনের নাটের গুরুদের দিয়েই আপনার এ্যাকশন শুরু করুন। প্রকৃত আওয়ামী লীগার ও সাধারন মানুষ আপনার পাশেই থাকবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.