ভুল শোধরিয়ে বিএনপি কী ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ?

0

– এস এম মনসুর নাদিম

তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট গত কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনে এই দাবিটিই ছিল সবচেয়ে বড় কারণ। বিএনপি-জোট বরাবরই বলে এসেছে, নির্বাচনকালীন সরকার নিরপেক্ষ হতে হবে এবং সেটি তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে। এতদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বললেও নির্বাচনকালীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক হওয়া চাই-এমন দাবি থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছে বিএনপি। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন যাতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারে সেই উদ্দেশ্যেই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রয়োজন। আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ভবিষ্যতে যথাসময়ে জাতির সামনে উপস্থাপন করবো।’ খালেদা জিয়া বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে বলেন, ‘গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে এবং গত কয়েক বছরের অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা এবং পক্ষপাতমূলক আচরণ দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণকে হতাশ, আস্থাহীন এবং ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। বৃহত্তর জাতীয় ও গণতন্ত্রের স্বার্থে এহেন পরিস্থিতি আর চলতে দেওয়া যায় না। জনগণ পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন চায় । তাঁরা নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, সক্ষমতা এবং দায়িত্বপালনে ন্যায়পরায়ন দৃঢ়তা দেখতে চায়।’ আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি তত্বাবধায়ক সরকার হোক আর যাই হোক নিজেদের লোক না হলে ‘মানিনা/ মানবনা’ই হবে। চলবে আন্দোলন। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবে। বিরোধীরা যে কোন কিছুর বিনিময়ে ক্ষমতায় যেতে চাইবে। রঙে ভরা এই বঙ্গদেশে তামাশা করার আর তামাশা দেখার লোকের অভাব নেই। বিএনপি যাদের সাথে ‘দিল দে চুকে সনম’ সম্পর্ক করেছে তারা বেশিরভাগ সময় রাজনীতির দাবার ঘরে ভুল চাল দিতে দিতে নিজেরা নিঃশেষ হওয়ার পথে। এখন তারা বিএনপিকেও নিঃশেষের তিমিরাচ্ছন্ন গহ্বরের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। পরবর্তীতে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার মানসে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে বি এন পি বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের জন্ম হয়।দল প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঁচবার দেশ শাসনের সুযোগ পেলেও এই দল কিছু ভুলের কারনে ২০০৬ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত ক্ষমতার বাইরে। আর এই সব ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে এখন সাধারন নেতা-কর্মীদের। এক সময়ের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি এখন অস্তিত্বের লড়াইয়ে নাকাল। চেষ্টা চলছে দলকে চাঙ্গা করার কিন্তু এখানেও কেন্দ্র ও তৃণমূলে একটি থমথমে ভাব থাকায় আশানুরূপ সাফল্য নজরে আসছেনা। নানা কারনে দলে বিভাজন। চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর ও দক্ষিন জেলা বিএনপি’র প্রথম সারির অসংখ্য নেতাকে দীর্ঘদিন ধরে দেখা যাচ্ছেনা দলের সাংগঠনিক কর্মসুচিতে। মাঠে ময়দানে দেখা না গেলেও দলীয় পদ আঁকড়ে বসে আছেন তারা। নিষ্ক্রিয় এসব নেতাদের কারনে দুই জেলায় বিএনপি’র রাজনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। দলীয় সুত্রে জানা যায়, যেসব নেতারা দলে থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন, তারা বিএনপি হাইকমান্ডের পর্যবেক্ষনে আছেন। গত ১৪ নভেম্বর বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসুচিতে জেলার সভাপতি সাধারন সম্পাদক তো বটেই, ছিলেননা ১২ জন সহসভাপতির কেউই। আগেও বিএনপি’র আন্দোলন গুলিতে দেখা গেছে নেতাদের পিছুটান। হরতাল আহবান করে ঘরে বসে থাকা নেতা দিয়ে আর যাই হোক আন্দোলনে সফলতা আসেনা। বিগত সময়ে ঘটে যাওয়া বিএনপি’র সহিংস আন্দোলন গুলিতে যদি নেতাগন রাস্তায় থাকতেন তবে আন্দোলন বিতর্কিত হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারনা। বিএনপি’র মতো জনপ্রিয় দল এর জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামতে শুরু করেছিল স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে যেদিন থেকে অন্ধের ষষ্ঠী ভেবে হাতে তুলে নিয়েছিল সেদিন । বিএনপি’র প্রবীন রাজনীতিবিদদেরকে একে একে বের করেছে সেই অপশক্তির কূট চালে। অবহেলিত হয়ে আছে দলের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। স্বাধীনতা বিরোধীদের অপছন্দের নেতাদেরকেও নানা বাহানায় কেন্দ্রীয় ক্ষমতার বলয় থেকে এবং স্থায়ী কমিটি থেকে দুরে রাখা হয়েছে। বিএনপি’র জন্মলগ্ন থেকে যারা দলটির সুখে দুঃখে বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়ার মাথার ওপর রোদ-বৃষ্টির ছাতা হিসেবে সর্বদা ছিলেন, কী এক অদৃশ্য ইঙ্গিতে তাদের সবাইকে সরে যেতে হল। আজ জামায়াত ছাড়া দলটি যেন অচল। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি যেমন অদুরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিল ঠিক ক্ষমতার বাইরে থেকেও আন্দোলনের রূপরেখায় মেধা ও কৌশলের পরিবর্তে উগ্রতা জিঘাংসা পরিলক্ষিত হয়েছিল। যা দলকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। রাজনীতিতে একটা কথা মনে রাখা দরকার ‘কাঁচের ঘরে বাস করে অন্যকে ঢিল ছুঁড়তে নেই’। কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি বরাবর সেই ভুলটি করে এসেছিল। মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামীলীগ নেতাদের নামে ব্রিজ, সড়ক ও স্থাপনার নাম যেখানে দেখেছে সেখানে তা পরিবর্তন করেছে। ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবসের সরকারী ছুটি বাতিল করে ঐ দিন বিএনপি নেত্রী তার কথিত জন্মদিন পালন করতে শুরু করেছিলেন যা খুবই স্পর্শকাতর ও বেদনা বিধুর। একদা আওয়ামীলীগের দাবির মুখে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যাবস্থা চালু করেছিল।এখন আওয়ামীলীগের কাছেই সেই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ব্যাবস্থার দাবি করে আসছে। অথচ তারা বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের পছন্দের লোককে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান বানাতে। সেখানে ব্যার্থ হয়ে দুটি অপশন অতিক্রম করে ইয়াজ উদ্দীন সাহেবকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান বানিয়ে দিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেনি বিএনপি। আজিজ মার্কা নির্বাচন করে দেড় কোটি ভুয়া ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আমি আজ পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে লিখতে বসিনি। বিএনপিকে ঘুরে দাড়াতে হলে পেছনের ভুল গুলি পর্যালোচনা করে শিক্ষা নেয়া জরুরী।

তারেক বাবর ও হারিছ চৌধুরী মিলে প্রতিদ্বন্ধি দল আওয়ামীলীগকে দমন করতেই র‍্যাব ও ক্রসফায়ার এর প্রচলন ঘটায়। এতে আওয়ামীলীগের হাতে ইস্যু তুলে দেয়া হয়েছিল । মানুষের সহানুভূতি আওয়ামীলীগের পক্ষেই গিয়েছিল। ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জজমিয়া নাটক, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি, বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই ইত্যাদি হাস্যকর কাণ্ড ও কথা-বার্তা বিএনপিকে সন্দেহাতীত ভাবে স্বৈরাচারের মুর্তপ্রতীক বানিয়ে দিয়েছিল । এ ছাড়া ১০ম জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা বিএনপি’র রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল । জামায়াত ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিতে বিএনপি নামক দলটি ধীরে ধীরে বন্ধুহারা হয়ে পড়েছিল। বন্ধু বা জোট বলতে বেশিরভাগই দিঘীর পাড়ের তালগাছ মার্কা নেতাদের প্যাড সর্বস্ব দলগুলি। ফলে নেতা-কর্মীদের মাঝে হতাশার সাথে সাথে দলটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেশি মাশুল গুনতে হয়েছে জিয়া পরিবারের সদস্যদের । বিএনপি’র আজ বড় দুঃসময়। একটি বৃহৎ জনপ্রিয় দলের এই অপ্রত্যাশিত দুঃসময়ের জন্য কে দায়ী সেই বিচার না করে ভুল গুলি যত তাড়াতাড়ি সনাক্ত করে সংশোধন করা যায় ততোই মঙ্গল। রাজনীতিতে যেমন শেষ কথা বলে কোন কথা নেই, ঠিক তেমনি মিঃ পারফ্যাক্ট বলে কোন নেতা নেই।জিঘাংসা, প্রতিহিংসা ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির চর্চা থেকে যতদিন রাজনৈতিক দল গুলি বেরিয়ে আসতে না পারবে ততদিন হানাহানি, গোলাগুলি, গালাগালি সহ রক্তাক্ত সংঘাত এড়ানো সম্ভব হবেনা।

রাজনীতিতে ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক কিছু স্পর্শকাতর বিষয় থাকে সেগুলো স্পর্শ না করাই উত্তম। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ তেমনি কিছু বিষয়। স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত আবদুর রহমান বিশ্বাসকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদ রাষ্ট্রপতির আসনে বসানোটাও বিএনপির একটি বড় ভুল ছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। বিএনপি বার বার মানুষ চিনতে ভুল করেছে। ক্ষমতায় থাকাকালে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে যে বিএনপি সবচেয়ে বেশি ভুল করে তার আরেকটি উদাহরণ হলো বেগম খালেদা জিয়ার আরেক রাজনৈতিক সচিব এম হারিছ চৌধুরী। স্বপদে থাকাকালে সরকারের এমন কোনো সেক্টর ছিল না, যেখানে তিনি নাক গলাননি । অর্থ ও সম্পদের বিরাট পাহাড় গড়ে তোলার পর দল ও জিয়া পরিবারের সদস্যদের চরম বিপদের মুখে ফেলে এমনভাবে উধাও হলেন, আজও তার আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা উড়ানো অন্যদিকে দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে অপসারণসহ দল থেকে বিতাড়নের সিদ্ধান্তকে সিনিয়র নেতাদেরও একটি বড় অংশ চরম ভুল বলেই মনে করেন। দলের অভ্যান্তরে দ্বিমুখী শাসন দলটার চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। খালেদা জিয়ার মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকী ও অন্য ব্যক্তিগত স্টাফরা বিএনপিকে বলতেন বিধবা নারীর দল, বেসিকেলি নো পার্টি। বিএনপি সরকারের সময় ঢাকায় জেলা প্রশাসক হয়েছে পাঁচজন। তার মধ্যে চারজনই ছিলেন জামায়াতী, একজন সাবেক মহাসচিব মরহুম আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার অনুগত। অথচ দলীয়করণের নির্মম বদনাম পড়েছে বিএনপির সরকারের ওপরই। এক সময় ছাত্রদল করতেন এমন কোনো কর্মকর্তা বিএনপি আমলে ঢাকা জেলার প্রশাসক হওয়া তো দূরের কথা, ভালো কোনো পোস্টিংও পাননি। নিজের লোকদের মুল্যায়ন না করে বিএনপি যেই ভুল করেছে তার পরিণাম আজকের বিএনপি। বিএনপি রাজনীতির সবচেয়ে বড় ভুলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- সরকারে থাকাকালে যাকে যে পদে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে, তিনি কখনোই জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে ছিলেন না এবং বেগম খালেদা জিয়ার আশপাশে থাকা ব্যক্তিরা হয় মোটা অংকের অর্থ কিংবা বৃহৎ কোনো সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর লোভনীয় পদগুলো বণ্টন করেছিলেন। আরও অনেক ভুল-ভ্রান্তির কাদাজলে ডুবে আছে বিএনপি’র ধানের শীষ । এই ভুলগুলি চিহ্নিত করে বিএনপিকে বিতর্কিত দলগুলি পাশ কাটিয়ে সম্ভব হলে একলা চলো নীতি অবলম্বন পুর্বক মান-অভিমান ভুলে দলের পরীক্ষিত নেতাদের সাথে নিয়ে ঘর গোছানো এবং আগামী নির্বাচনের জন্য দলকে তৈরি করাই হবে প্রথম কাজ।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.