চন্দনাইশ জামিজুরীতে ১৪ শহীদের বধ্যভূমি এখনো অবহেলিত

0

মো. দেলোয়ার হোসেন, চন্দনাইশ : ১৯৭১ সাল। পুরো দেশজুড়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্যাতন। সে নির্যাতনের শিকার হন দোহাজারী জামিজুরীর কয়েকটি হিন্দু পরিবার। সেখানে ১৪ জন লোককে দিন দুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে একই গর্তে সবাইকে পুঁতে ফেলা হয়। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও এ বধ্যভূমিতে এখনো সরকারি কোন সাহায্য সহযোগিতায় কোন স্থাপনা বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়নি। হয়েছে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ১৪ জনের নাম সম্বলিত একটি স্মৃতিফলক।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। এর পর পাক হানাদার দল ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালী নিধনে। বাঙালী নিধনের অংশ হিসেবে তারা বেছে নিয়েছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত এলাকাগুলো। তারই ধারাবাহিকতায় হানাদার বাহিনী মানব হত্যার নিমর্মতায় মেতে উঠেছিল সেদিন চন্দনাইশ (তৎকালীন পটিয়া থানার) দোহাজারী জামিজুরী গ্রামে। সারা দেশের মত এ গ্রামটিও রক্তে রঞ্জিত হয় ৭১’র এ দিনে। হানাদার বাহিনীর নিমর্মতায় বলী হয় ১৪ জন। সেদিন শাহাদত বরণকারী শহীদদের স্মৃতিকে ধরে রাখার প্রয়াসে স্থানীয় ক’জন প্রগতিশীল তরুণের অক্লান্ত পরিশ্রমে দোহাজারী জামিজুরীতে গড়ে উঠে এ বধ্যভূমি।

বধ্যভূমির বেধীটি স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও কোন রকম সরকারি বরাদ্দ ছাড়াই গড়ে উঠেছে। দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও পাক হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসর-রাজাকার, আলবদরদের বিচার হয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং একান্ত আন্তরিকতার কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলেও এখনো এদেশীয় দোসর-রাজাকার, আলবদরদের বিচার হয়নি। এদের হাতে নির্মমভাবে সেদিন শহীদ হয়েছিল ১৪ জন। এ সকল শহীদদের পরিবার-পরিজনের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখার গরজ কেউ অনুভব করেনি অদ্যাবধি। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়সহ রাষ্ট্রীয় কোন আনুকূল্যও তাদের ভাগ্যে জুটেনি। সরকারের সদিচ্ছার আলোকে কয়েক দফা ছবি তুলে তথ্য সরকারিভাবে উপরে মহলে পাঠানো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বধ্যভূমি রক্ষণাবেক্ষণকারী সুনীল কান্তি ভট্টাচার্য্য।
দোহাজারী জামিজুরীর এ বধ্যভূমিটি সরকারি কোন দপ্তরে নথিভুক্ত হয়েছে কিনা তাও কারো জানা নেই। অথচ পাক হানাদার বাহিনী লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে ১৪ জনকে ঝাঝড়া করে তাদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। তারা তাদের স্বাভাবিক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান থেকেও বঞ্চিত হয় নরপশুদের পাশবিকতার কারণে। ফলে অনেক দেরীতে নিহতদের একটি গর্তে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল। অবশ্যই তার আগে মুখে একটু আগুন লাগিয়ে মুখাগ্নির ব্যবস্থা করে কিছুটা দায় কমানোর চেষ্টা করা হয়েছিল সেদিন।
সরজমিনে দোহাজারী জামিজুরী শহীদ বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, অনেকটা অযতœ-অবহেলা এবং অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে মহান স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিলিয়ে দেয়া ১৪ জন শহীদদের বধ্যভূমিটি। স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী শহীদেরা হলেন ডা. বগলা প্রসাদ ভট্টাচার্য্য, মাষ্টার প্রফুল্ল রঞ্জন ভট্টাচার্য্য, কবিরাজ তারাচরণ ভট্টাচার্য্য, মুক্তিযোদ্ধা বিমল দাশ (নলুয়া), মাষ্টার মিলন কান্তি ভট্টাচার্য্য, বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য্য, ডা. করুণা চৌধুরী, অমর দাশ, হরিরঞ্জন মজুমদার, মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ দাশ (আমিরাবাদ), রেনুবালা ভট্টাচার্য্য, নগেন্দ্র রাণী, মনিন্দ্র দাশ ও রমনী দাশ।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শহীদ ডা. বগলা প্রসাদ ভট্টাচার্যের স্ত্রী মাধুরী লতা ভট্টাচার্য্য গত দুই বৎসর আগে জীবিত থাকা অবস্থায় সে স্মৃতি অকপটে বলেছিলেন। তিনি সম্পূর্ণ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছিলেন, রাজাকারদের সাথে এদেশের কিছু লোকও ছিল। তারা প্রথমে তারাচরণকে গুলি করে হত্যা করে। পরে বৃষ্টির মত গুলি করেছে। অনেকের মাথার খুলি পর্যন্ত উড়ে যায়। অতিথি একজনসহ ১৪ জনকে হত্যা করে দড়ি দিয়ে বেঁধে তাদের ঘরের পিছনের গর্তে ফেলে মাটি দিয়ে দেয়। ঘটনার দিন ছিল বুধবার ১৪ বৈশাখ, ২৮ এপ্রিল ১৯৭১ সাল। কালের সাক্ষী হিসেবে সৃষ্টিকর্তা তাঁকে স্বাধীনতার পর ৪৩ বছর বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। গত দুই বৎসর আগে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

শহীদ ডা. বগলা প্রসাদের ছেলে ডা. সুনীল ভট্টাচার্য্য বলেন, স্বাধীনতার পর পর বঙ্গবন্ধু সরকার থেকে মাত্র ২ হাজার টাকার সাহায্য পাওয়া যায়। আর কোন সাহায্য সহযোগিতা সরকারি বা বেসরকারিভাবে শহীদ পরিবারগুলো পায়নি। তারা কোন সাহায্য না পেলেও নিজস্ব তাগিদে ১৪ জন শহীদের সমাধিস্থলে তাদের নাম র্লিখে একটি বেধি নির্মাণ করেছেন। বধ্যভূমিটি সংস্কার করার জন্য সাবেক সাংসদ আ’লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার আফছার উদ্দিন আহমদ তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ১৫ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। এছাড়া আর কোন নেতা-কর্মী এ বধ্যভূমির জন্য অর্থদান তো দূরের কথা, অনেকে দেখতে পর্যন্ত আসেনি। বর্তমানে তিনি শহীদদের সমাধিস্থলে বেধি নির্মাণ করে মাটি ভরাট ও বাউন্ডারী দিয়ে অনেকটা ঋণ কমানোর চেষ্টা করেছেন। এতে তাঁর ৫ থেকে ৬ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানান।
সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য পাওয়া যাক বা না যাক প্রতি বছর ১৪ বৈশাখ স্থানীয়ভাবে এ বেধিমূলে দিনব্যাপী স্মৃতিচারণসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কিন্তু সে অনুষ্ঠান আয়োজনেও বাঁধাগ্রস্থ হয় অনেক সময়। অনুষ্ঠান করার জন্য ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য হিসেবে পালন করছেন চাগাচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক সুশীল কান্তি ভট্টাচার্য্য, সাধারণ সম্পাদক বিকাশ মজুমদার। এলাকাবাসী চান ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রয়োজনে ইতিহাস সংরক্ষণে সরকারিভাবে এ বধ্যভুমিটি সংরক্ষণ করা হোক। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সনজীদা শরমিন বলেছেন, আমাদের যতগুলো বধ্যভুমি বা স্মৃতিচারণ করার জায়গা রয়েছে, যা স্বাধীনতার স্মৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট। সবগুলোতে আমরা স্মৃতিস্তম্ভ করার জন্য পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে তালিকা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। বরকল-সুচিয়াতে যে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করার কাজ চলছে, সেটি শেষ হলে পর্যায়ক্রমে সবগুলোর কাজ করা হবে। সে সাথে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ ও প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। যা ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন করা হবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.