কেউ ফিরে আসেনি

0

সাহিত্য, নাহিদা নাহিদ : মৌ খুব অস্থির হয়, মাথা চেপে ধরে। নিজের ওপর বিরক্ত হয়। ভাদ্র মাসের এই গরমে কি প্রয়োজন ছিল তার রোদে হাঁটার? এ সময় নাকি গরমে তাল পেকে গাছ থেকে টুপ করে পড়ে যায়। তার মাথাটাও টনটন করছে ব্যথায়। এখন শুধু ধর থেকে পড়াটা বাকি। উফ, পূজার ঘরে মাকে কেউ যদি ম্যাসেজটা পৌঁছে দিতো। একটু যদি থামতো মা! একে তো অন্ধকার ঘরে গুমোট বাতাস, তার মধ্যে ঢং ঢং করা শব্দ। মৌ কাতরায়- মা, মাগো তোমার হাতের ঘণ্টাটা একটু আস্তে বাজাও না মা। কতো শাঁখ বাজিয়েছো, কতো উলু দিয়েছো, কপালজুড়ে সিঁদুরও তো কম পরোনি? ইষ্ট দেবতাকে কি পেরেছো এতো সহজে তুষ্ট করতে? এবার একটু থামাও না মা।

হঠাৎ শব্দটা থেমে গেলো। ঘরের বাতাসটাও ঠাণ্ডা হয়ে আসে, মৌ হাসে, বুঝতে পারে বাবা এসেছে। অনেক দিন পর মৌ ব্যস্ত হয়। কতটা সময় পর এলো বাবা। অভিমান করা কি উচিত হবে? নাহ হবে না, মানুষটা এমনই আলাভোলা, বেখেয়ালে। আচ্ছা ছোটদের মতো ঠোঁট ফুলালে কেমন হয়? না হয় হলোই একটু আহ্লাদ।

ও বাবা তুমি কেমন গো? কেমন করে পারো এতো চুপি চুপি এসে আবার ফিরে যেতে। মায়া হয় না, আদর লাগে না। তোমাকে বকতেও ইচ্ছে হয় না আর। তুমি তো এমনই! আমার পাগল বাবা।

ও বিচ্ছিরি বাবা, একটু আগে বলতে পারলে না আসবে তুমি! ভর সন্ধ্যায় ঘরে প্রদীপও দেইনি আজ, সলতে পাঁকানোর সময়ই ছিল না। ইশ, জানালার ফাঁকে যদি একটু আলো থাকতো, কোন তিথি, কোন পক্ষ, কোন কাল চলছে এখন, কে জানে? পঞ্জিকা দেখা হয় না কতো কাল। আর দেখেই বা কী হবে? আমাদের জন্য তো বছরের বারো মাসই কৃষ্ণপক্ষের গ্রহণকাল।

বাবা কেমন আছ বলো এবার? কতদিন জানা হয় না তোমার খবর। অবশ্য তোমাকে না দেখতে না দেখতে তোমার মুখটাও আজকাল কেমন অচেনা ঠেকে। চাইলেও আর যখন-তখন মনে করতে পারি না। ভাগ্যিস বসার ঘরে ফটোটা ছিল তোমার! না হয় মানুষ ডেকে জানতে হতো আমার বাবা দেখতে কেমন?

হাসছো তুমি? খবরদার হাসবে না। হেসে হেসে ভাব করতে চাইছো, কোনো লাভ নেই। আমি এখন বুঝতে পারি সব। ভোলানোর ফাঁকটুকুও বুঝি।

রাজকন্যা বলছো? দরকার নাই শোনার। আমি তো তোমার মতো এতো রাগও করি না, অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে চুপটি করেও থাকি না।

কোলে নেয়ার ঢঙ করো না তো, আমি আর ছোট্টটি নেই। এই বুড়ো বয়সে আমার দাঁতে পোকা হয়নি যে দেখতে হবে কাছে এসে। তোমার দেখার সময় শেষ বাবা, তাড়াহুড়ায় তোমার মেয়ের বয়সটা বেড়ে গেছে। পাত্র দেখা চলছে তাই। তারাই এসে দেখে নিক সব ঠিকঠাক। তুমি দেখে কী করবে?

চুল দেখছো, আচ্ছা দেখ। কী আর দেখবে? আগের মতো বিনুনি করি কিনা? না করি না।
মাথায় যত্ন করে ফিতা বাঁধার সময় কই আমার? দু-দুটো টিউশনির বোঝা মাথায়।

প্রশ্ন করো না, কেন রোগা হয়েছি? কেন চোখের নিচে বিচ্ছিরি কালি, কেন আমি ঘুমাই না রাতে? এসব তোমার শোনা বারণ। বলতে চাই না আমার স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট, কেন অযথা জানতে চাও সব?

আমি রাত জেগে এখন ইকারুস আর অর্ফিয়াসের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। পেন্ডোরা বক্সের গল্প শুনাই তৃষ্ণার্ত মানুষকে। বইয়ের তাকের ধূলা সরাই। পড়ে পড়ে ক্লান্ত হই, অবশেষে রবি ঠাকুরে আশ্রয় খুঁজি।

তোমাকে বলার সুযোগ পাইনি বাবা। আমারও একটা কিউপিড ছিল, সুনীলের ভালোবাসি কবিতা কতো শুনিয়েছি তাকে। ভুলে গেছে সবটা সে, রিভিশন করার সময় পায়নি যে। সেসব গল্প আজও অলিখিত। লিখিনি কোথাও। লিখে আর কী হবে বলো? সেসব স্বার্থপর ঘর আর পরের গল্প!

তোমার কাছে কিছু প্রশ্ন ছিল। ধর্মরাজকে বলে উত্তরগুলো খুঁজে দিও কিন্তু। জিজ্ঞেস করো তাকে- ‘কার দণ্ডে আমি দণ্ডিত?’
আমাকেই কেন এতো শাসায় সে-
দেখো না কিছু
ধরো না কিছু
ছুঁইও না কিছু
কল্যাণ কিছু আমার চাইতে নাই। সবকিছু এমন কেন? মন্দ ভাগ্যের দায় শুধু আমার একার।
বলত বাবা, কীসের এতো অভিশাপ আমার? শুরুটা তো তুমিই করলে-
সেই যে তুমি চুপচাপ চলে গেলে, সেই যে। মনে আছে তোমার?

আমরা এক আত্মীয় বাড়ি গেলাম। হলুদের প্রোগ্রাম ছিল আত্মীয়ার । তোমাকে রেখে গেলাম শূন্য ঘরের পাহারায়। গেলাম তো গেলাম আবার ফিরেও এলাম, কিন্তু তোমার আর অভিমান গেলো না। কতজন এসে ডাকলো তোমায়, এমন কী পুলিশও এলো। তুমি দরজা খুললে না। এতো অবুঝ কেন বাবা তুমি, এতো রাগ করতে হয়। মামারা ফোন করে কতো কী বলল। মা কাঁদছিল খুব। হতবাক সবাই তবুও একটা কথাও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি আমার। আমার বাবুটা এতো অবুঝ কেমন করে হবে? মাত্র দু’দিনেই এতো রাগ। নাহ আমি ডাকলে ঠিক সাড়া দেবেই। আমি ডাকতে এসেছিলাম। এসে দেখি তুমি বুকের ওপর হাত জড়ো করে রেখেছো, কেমন যেন ঘোলা দৃষ্টি, এর আগে এমনটা কখনো দেখিনি তোমার, হাত ঠাণ্ডা, পা ঠাণ্ডা!

আমার শান্ত বাবাটা কেমন নিশ্চুপ হয়ে পড়ে আছে, ঠিক যেন ছোট্ট এক শিশু।

আমাদের ঘরটা আর আগের মতো নাই বাবা, কেমন প্রাণহীন, নিরানন্দ, আমরা এখন জোর করে ক্লান্ত হই ঘুমিয়ে পড়ার জন্য। আমি, মা, বৌদি আর আমাদের টুনটুনিটা। বড়দা আগের চেয়ে গম্ভীর এখন। শহরে যায় রোজ, সপ্তাহ শেষে বাসায় ফেরে আবার, আমরা ভয়ে ভয়ে সারা সপ্তাহ তার ফিরে আসার অপেক্ষা করি। আমাদের প্রাণ ঢিপ ঢিপ করে, অবলা চারটা প্রাণ। হেসো না বাবা, অবলা শুনে বক্তৃতা দিও না যেন, মাস্টার মানুষ তো! বলা যায় না কিছু।

সবচেয়ে বড় অসহায় লাগে মাকে। যে মা এককালে তোমার ফরমায়েশি চা বানাতে বানাতে ক্লান্ত হয়ে যেতো। আজ সেই মায়ের হাতে কোনো ফরমায়েশ নেই। আমরা দুজন পাশাপাশি শুয়ে দীর্ঘরাত জাগি নিশ্চুপ। মা এখন সময় কাটায় অসুস্থতায়, কেমন চুপচাপ, ভয় হয় আমার! কবে জানি বায়না করে বসে তোমার কাছে যাওয়ার জন্য!

তোমাকে এসব বলে কী হবে? তুমি তো স্বার্থপর! এতো স্বার্থপর বাবা পৃথিবীর কারোরই হয়তো নাই আর। তুমি নিজে তো গেলেই চুপি চুপি আবার ছোড়দাটাকেও নিয়ে গেলে একইভাবে। মায়ের কথা একটিবার ভাবলে না? আমার কথাও না?
ঘর-ভরা মানুষ দেখে এতো চোখ টাটালো?

সেই একই নিশ্চুপ ঘর, পাড়া-প্রতিবেশীর ডাকাডাকি অবশেষে পুলিশে সমাপ্তি। তারপর ঠাণ্ডা হাত আর ঘোলাটে চোখ। তোমার মতো করে ছোড়দাটাকেও কতো ডাকলাম। চিতার গনগনে আগুনে তোমার সাধ পূর্ণ হলো। তুমি তো জানতে বাবা, আমরা ছোড়দার জন্য পাত্রী খুঁজছি, দাদারও মনের ভেতর কেমন যেন স্বপ্ন ছিল। মধুবালা বা বৈজন্তী রেখা কেউ না কেউ এসে আমাদের ছোট্ট উঠোনে ফেলবে তার মায়া রাঙা চরণ। মা আবার শাঁখ বাজাবে, পাড়ার কাকিমা-জ্যাঠিমারা এসে উলু দেবে-
হলো না কিছুই। শূন্যে ভেসে গেলো সব। তোমার যম ব্যাটাকে যদি পাই একবার; আচ্ছা রকম বকবো আমি।

গতবারও ভাইফোঁটায় আমি রাখি, চন্দন আর উষের জল নিয়ে আমার ভাইকে ফোঁটা দিয়েছি, মন্ত্রও পড়েছি-
‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যম দুয়ারে পড়লো কাঁটা।’
কাঁটা না ছাই! বরং দুয়ারটা খুলে গেলো হা করে, আত্মীয়তা বাড়লো আরো। টুপ করে নিয়ে নিলো ছোড়দাটাকে। যমের সঙ্গে তার বোন যমুনাকেও বকবো কিন্তু।
আমার নন্দন ভাইটার চন্দন সাজ তার সহ্য হয় না। ঠিক ঠিক তারই ষড়যন্ত্র! কী হিংসুটে। ধুৎতরি ছাই কাঁদবো না বলেছি, কাঁদবো না।

আচ্ছা বাবা তুমি কি নন্দন কাননের পারিজাত ফুলের গাছটা দেখেছো? ফুলগুলো কেমন দেখতে? অলকানন্দা, রঙ্গন নাকি আমাদের ঘরের পাশে লাগানো জবা ফুলের মতো? গন্ধটা কেমন? গন্ধরাজ না রাতের হাসনাহেনা? আনতে একটা!

একটা কথা মনে পড়ে হাসি পাচ্ছে।
বলবো?
আচ্ছা বলি।
বাবা তুমি উর্বশি রম্ভাকে আর মেনকা মাসীকে দেখেছো?
কেমন রূপ গো বাবা?
নাচে কেমন? তোমাকে কখনো দেখিয়েছে নাচ?
জান বাবা, আমিও এখন নাচ করি। এবার ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রামে নেচেছি। থিয়েটারের শোতেও সেজেছিলাম সাঁওতালি মেয়ে। এতকিছু হলো শুধু দেখার সময় হলো না কারো।
সময় তোমার হয়নি
সময় ছোড়দার হয়নি
সময় সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটারও হয়নি
ভাবছি চিত্রগুপ্তের খাতার মতো বড় একটা খাতা করে লিখে রাখবো সব। পরের জন্মে হিসাব চাইতে সুবিধে হবে।
হিসাব চাইবো এক সকালে দুর্বা ঘাস মাড়িয়ে শ্যামা কালির মন্দিরে বাবাকে নিয়ে যেতে না পারা কষ্টের।
হিসাব চাইবো কোনো এক দুপুরে ছোড়দাসহ মায়ের আঁচল ঘেঁষে ইলিশ ভাজা খেতে না পারা বিস্মৃতির। আর হিসাব চাইবো সেই মানুষটাকে লেখা অজস্র চিঠির উত্তর না পাওয়া ব্যর্থতার।
ছোট্ট ছোট্ট পুতুল গড়া শখের। স্বপ্ন ভাঙা সাধের।

ওকি ফিরছো কেন? চলে যাচ্ছ? যেও না বাবা। শুধু আজকে তুমি আসবে বলে বাঁশের চাকে আমি রক্তজবা পুঁতে রেখেছি, শীতলা দেবীর মন্দিরে পূজো দিয়েছি। আর একটু থাকো না।

ও বাবা, তোমার ফেরার ঘণ্টাটা এতো জোরে বাজছে কেন? স্বর্গদ্বারের প্রহরীদের কী হলো? ক্ষ্যাপল কেন আজ? এতো জোরে কেউ বাজায়? উফ, ঘরের মধ্যে বাজছে এখন। একেবারে মাথার মধ্যে। একেবারে যাচ্ছেতাই।

মৌ হাত বাড়ায়। হাতের কাছে অ্যালার্ম দেয়া মোবাইলটা খুঁজে পায়। রাত ১২টায় রিমাইন্ডার দিয়ে রেখেছে টুনটুনিটা, আজ তার পিসিমনি মৌমিতার জন্মদিন।

এই ভাদ্র মাসের গরমে মৌ একেবারে ঘেমে ভিজে উঠেছে। বিকেলে টিউশনি থেকে ফিরে বাসি কাপড় না ছেড়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। জানালাটা ওরকমই আছে। শুধু মা এসে কয়টা ধূপ জ্বালিয়ে রেখে গেছে। জন্মদিনের সুগন্ধী আয়োজন, মৌ হাসে একটু। ফোনটা হাতে নেয় সে, অনেক টেক্সটই এসেছে, আসেনি শুধু প্রত্যাশিত মানুষটির শুভকামনার বার্তা। মৌ জানে আসবে না, যেমনটা আসেনি তার মৃত বাবার আত্মাও। বৃথাই অপেক্ষা। সবই স্বপ্ন, সবই ঘোর। বছর ঘুরে জন্মদিন আসবে, রাখি বন্ধনের দিন আসবে, আসবে ভালোবাসা দিবসও। আসবে না শুধু বাবা, ছোড়দা আর সেই মানুষটা।
ফিরবে কী করে?
হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর যে ফিরে আসার নিয়ম নেই। সূত্র-জাগোনিউজ

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.