পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে সংশয়: দক্ষ জনবলে দূর হবে সব ভয়

0

খন রঞ্জন রায় – 

উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে এবং ক্রমবর্ধমান নাগরিক চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পুনরুত্থান। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নদর্শী নেতৃত্বাধীন সরকারের জ্বালানিনীতির কারণেই এর পূণজন্ম। দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে সরকার দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানিনীতি প্রণয়ন করে। যেখানে দেশের মোট বিদ্যুতের শতকরা ৫০ ভাগ কয়লা, ২৫ ভাগ গ্যাস এবং অবশিষ্ট ২৫ ভাগ পারমাণবিক ও নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করা হবে বলে ঘোষণা করেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।

তুলনামূলক কম খরচের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্তমানে ৩১ টি দেশে ৬৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু আছে। ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১৬৮ হবে। রূপপুর প্রকল্পে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে রাশিয়া। বাকি ২২ হাজার ৫৩ কোটি টাকা দেবে সরকার নিজে। পরমাণু শক্তি কমিশন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মধ্যে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ষ্টেট এক্সপোর্ট ক্রেডিট চুক্তি ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে। আট বছরে এ অর্থ পাওয়া যাবে। আর পরিশোধ করতে হবে ২০ বছরে। তবে ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড। এ ঋণের সুদের হার লন্ডন ইন্টারব্যাংক অফারড রেটের সঙ্গে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে তা কখনো ৪ শতাংশের বেশি হবে না।

২০২৫ সালের মধ্যে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কমিশনিং, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ কাজ করবে। এছাড়া প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ইউনিটে বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োজিত থাকবে আরো ৩৬৯ জন। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় থাকাকালে ছোট পরিসরে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তখন এটি ছিল ২০০ মেগাওয়াটের। সে সময় পরমাণুবিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়াকে এ সম্পর্কিত প্রকল্পের পরিচালক করা হয়।

বঙ্গবন্ধু নিহত হলে প্রকল্পটির কার্যক্রম থেমে যায়। ১৯৯৬ সাল আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে আবার উদ্যোগ নিলেও আর্থিক কারণে তা সম্ভব হয়নি। এখন রাশিয়ার সহযোগিতায় এটি করা হচ্ছে। এটি হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের প্রকল্প। এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০ বছর ধরে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। কেন্দ্রের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিটটি ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

আশার কথা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল তৈরির সুপারিশ করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। যদিও ইতিমধ্যে ভারতে ৫৫ জন কর্মকর্তা ‘ফাউন্ডেশন কোর্স অন নিউক্লিয়ার এনার্জি’ বিষয়ক প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। আরও ৩০-৩৫ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হবে। রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ২ হাজার ৫৩৫ জন জনবল প্রয়োজন হবে।

তাদের মধ্যে ১ হাজার ৪২৪ জনকে রাশিয়ায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নকশা ও নিরাপত্তার জন্য ৪৭ জন শিক্ষার্থীকে রাশিয়ায় নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
কৃষি, খাদ্য, খনিজ সম্পদ আবিষ্কার ও উত্তোলন নিউক্লিয়ার মেডিসিন পারমাণবিক সাবমেরিন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল আমাদের নেই। নিউক্লিয়ার যন্ত্রপাতিও সম্পূর্ণভাবে বিদেশ থেকে আমদানিনির্ভর। নিউক্লিয়ার যন্ত্রপাতি তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইনস্ট্রুমেন্ট মেকিং ও মেইনটেন্যান্স প্রযুক্তিবিদ প্রশিক্ষণের স্থায়ী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সর্বক্ষেত্রে একটি উন্নত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে হলে নিজেদের পারমাণবিক কাজের ক্ষেত্রে, পরিধি নিজেকেই সৃষ্টি করতে হবে।

এ ব্যাপারে ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ নিুোক্ত ৮ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছে। ১. সরকারি, আধা-সরকারি কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, খনিজ সম্পদ, আবিষ্কার ও উত্তোলন নিউক্লিয়ার মেডিসিন, পারমাণবিক সাবমেরিন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন নিউক্লিয়ার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত টেকনোলজিস্ট নিয়োগনীতি প্রণয়ন ও নির্দেশনা প্রদান। ২. সকল পারমাণবিক প্রতিষ্ঠান কর্মকাণ্ড থেকে কর্মরত প্রশিক্ষণবিহীন চাকরিজীবীকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে পরমাণু বিষয়ে শিক্ষাপ্রাপ্তদের নিয়োগে নির্দেশনা প্রদান। ৩. চার বছর মেয়াদি কৃষি, খাদ্য, প্রক্রিয়াকরণ, খনিজসম্পদ আবিষ্কার উত্তোলন, নিউক্লিয়ার মেডিসিন, পারমাণবিক সাবমেরিন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইনস্ট্রুমেন্ট মেকিং মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা কোর্স চালু। ৪. সরকারি সিটি কর্পোরেশন, বেসরকারি উদ্যোগে জেলা উপজেলায় একাধিক এটমিক ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা ও নির্দেশনা প্রদান। এ বিষয়ে ডিপ্লোমা ইন এটমিক ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা নীতি সহজ ও সরলীকরণের লক্ষ্যে ব্রিটিশ পাকিস্তানিদের বিচ্ছিন্ন মতাদর্শের ডিপ্লোমা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী ৭টি প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা শিক্ষা কার্যক্রম পৃথক করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রশাসনিক বিভাগে স্বাধীন স্বতন্ত্র ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠায় নির্দেশনা প্রদান। ৬. উন্নত বিশ্বের মতো ‘বিভাগীয় ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড’ প্রদত্ত ডিপ্লোমা ইন এটমিক ডিগ্রিপ্রাপ্তদের নিয়োগ এবং উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থায় নির্দেশনা প্রদান। ৭. উপজেলার বিসিক শিল্পনগরী, জেলা, বিভাগীয় ভারী শিল্পনগরী, ইপিজেডে নিউক্লিয়ার ইনস্ট্রুমেন্ট শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য ডিপ্লোমাধারীদের সহজ শর্তে প্লট বরাদ্দ ও ব্যাংক ঋণ প্রদানের নির্দেশনা। ৮. ক) বাংলাদেশে প্রস্তুত নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি সকল মন্ত্রণালয়ের অধীনে অধিদপ্তর, শিল্প কারখানা, হাসপাতালে ব্যাপক সংযোগ ঘটানো। খ) বাংলাদেশে প্রস্তুত যন্ত্রপাতি বিদেশে রপ্তানি প্রদানে নির্দেশনা।
আর তা সম্ভব হলেই পারমাণবিক প্রকল্পের সংশয়ের জায়গাগুলি হবে শংকামুক্ত। পারমাণবিক প্রকল্প বিরোধীতাকারীরা আয়নাবাজীর দূষে দুষ্ট হবে। ক্রমবর্র্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে বিমূর্ত প্রকল্প মূর্ত রূপ লাভ করবে। বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিশাল জমির সাশ্রয় হবে। উচ্চ প্রবৃদ্ধির আকাক্সক্ষা দ্রুত বাস্তবায়ন হবে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বলয়ে প্রবেশ করবে এদেশের ঘনবসতির আপামর জনগণ।

লেখক পরিচিতি –
মো. আবুল হাসান, সভাপতি
খন রঞ্জন রায়, মহাসচিব
ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ।
৪৭, মতি টাওয়ার, চকবাজার, চট্টগ্রাম।
০১৭১১ ১২২৪২৫, ০১৮২০ ১৩০০৯০
khanaranjanroy@gmail.com

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.