মাছ পরিবহনের “বরফ বাক্স”: এখন আফ্রিকাতেও ব্যবহার হচ্ছে

0

মো. ইউসুফ আলী

কয়েক বছর পূর্বই সুলভ বরফ-বাক্স ও বরফের অভাবে বাংলাদেশে মাছ ধরার পর থেকে বাজারজাতকরণের বিভিন্ন ধাপে প্রায় ২৫-২৮ শতাংশ মাছ পচে নষ্ট হয়ে যেত। ওই সময়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া মাছের বাজার মূল্য ছিল ১০,৫০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের মতো একটি গরীব দেশের জাতীয় খাদ্য-নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এটা একটা মারাত্মক ক্ষতি। তা ছাড়া গরীব মৎস্যজীবী, মাছ চাষী ও মাছ-ব্যবসায়ীদের জন্যও এটি একটি বিপুল অর্থনৈতিক লোকসানের কারণ ছিল। মাছের এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতি কমিয়ে এনে ক্রেতার হাতে সঠিক মানসম্পন্ন মাছ তুলে দেয়ার জন্য কাজ করে স্বল্প ব্যয়-সাশ্রয়ী বরফ বাক্স প্রযুক্তি উদ্ভবনে সাফল্যতা পেয়েছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ও বিশ্ব খাদ্য সংস্থা এফএও এর সাবেক মান নিয়ন্ত্রন পরামর্শক ড.এ.কে.এম নওশাদ আলম। বর্তমানে বরফ বাক্সগুলি সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি দূর-দূরান্তে মাছ পরিবহণের কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করার ফলে পচন অনেক কমে গিয়ে মাছের গুণাগুণ যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। বরফ বাক্সের ব্যবহার ও উন্নত পরিচর্যার ফলে মাছের আহরণোত্তর পচন ২৮ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে বলে অতি সম্প্রতি এফএও এর অর্থায়নে পরিচালিত এক গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত এক দশকে মাছের আহরণ-পরবর্তী ক্ষতি দুই-তৃতীয়াংশ কমে আসাতে এখন বাৎসরিক প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে, যা আমাদের বার্ষিক মৎস্য পণ্য রফতানী আয়ের দেড়গুণ। সস্তা ও সহজলভ্য বস্তÍা দিয়ে তৈরি এবং বেশ কার্যকরী বলে বরফ-বাক্স তৈরির প্রযুক্তিটি এখন আফ্রিকার কয়েকটি দেশেও ব্যবহার হচ্ছে এবং দরিদ্র মৎস্যজীবীদের দীর্ঘদিনের দূঃখ ঘোচাচ্ছে।

মাছ বাজারজাত ও প্রক্রিয়াজাতকরণে নিজের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সম্পর্কে ড. নওশাদ আলম বলেন, বিগত দশকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দূর-দূরান্তে মাছ পরিবহণের চিত্রটি ছিল অত্যন্ত করুন। দূর-দূরান্তে মাছ পরিবহণের জন্য সাধারণত বড় বড় বাঁশের ঝুড়ি ব্যবহার করা হতো। ২-৩ মন মাছ ধরে এই রকম একটি বাঁশের ঝুড়ির চারিদিকে পলিথিন জড়িয়ে উঁচু করে ৪-৫ মন মাছ রেখে নাম-মাত্র বরফ দিয়ে পর পর দুইটি ঝুড়ি একটির ওপর আর একটি বসিয়ে ট্রাকে পরিবহণ করা হতো। এইভাবে পরিবহণ করার ফলে ওপরের ঝুড়ি ও মাছের চাপে নিচের ঝুড়ির মাছ পচে নষ্ট হয়ে যায়। মাছ বিক্রেতাদের সংগঠিত করে ট্রাকে মাছ পরিবহণের জন্য ড. নওশাদ আলম একটি বড় আকারের বরফ বাক্স প্রবর্তন করেন। পাশাপাশি অবিক্রিত মাছ সংরণের জন্য একটি ছোট বরফ বাক্সও তৈরি করা হয়। অল্পদিনের মধ্যেই শহরের বড় বাজার ও বাহারছড়া বাজারের প্রায় সকল মাছ বিক্রেতারা নিজ খরচে নতুন বরফ বাক্স তৈরি করে ব্যবহার করতে থাকেন। বরফ বাক্স তৈরির পদ্ধতি খুব সহজ। দেশীয় সহজলভ্য বস্তু দিয়ে তৈরি বলে এটি বেশ সস্তা, শক্তিশালী ও সহজে পরিবহণযোগ্য। কক্সবাজার থেকে শুরু হলেও এই সহজ ও টেকসই প্রযুক্তিটি চট্টগ্রাম, ঢাকা, যশোর, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের প্রধান প্রধান মাছ উৎপাদন ও ব্যবসা অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পরে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের শেষে দেশের প্রায় সকল মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, আড়ৎ বা মাছ বাজারে বরফ বাক্সের ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হতে দেখা যায়।

অবিক্রিত মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফ বাক্স অপোকৃত ছোট। এতে বরফসহ প্রায় ৪০-৫০ কেজি মাছ ধরে। ৩০ ী ২৪ ী ১৮ ইঞ্চি আকারের বাক্সটির ভিতর ও বাইরের দেয়াল জিআই সীট দিয়ে তৈরি। তাপ-অপরিবাহী করার জন্য ভিতর ও বাইরের দেয়ালের মাঝখানে ১ ইঞ্চি পুরু কর্কসীট বসানো। উপরের ঢাকনাটিও একই ভাবে তৈরি। বরফগলা পানি বের হয়ে যাওয়ার জন্য বাক্সটির পার্শ্বদেয়ালের নিচের দিকে একটি কল লাগোনো রয়েছে।

দূর-দূরান্তে মাছ পরিবহণের জন্য বরফ বাক্স জি আই সীট দিয়ে তৈরি ৩’ ী ২.৫’ ী ২’ আকারের একটি বাক্স চারিদিকে লোহার এঙ্গেল-বার ও ফাট-বার এর ফ্রেমের ভিতর বসিয়ে ট্রাকে পরিবহণের উপযোগী করা হয়েছে। বাক্স তৈরিতে কাঁচামাল হিসাবে প্লেইনসীট, এ্যাংগেল, ফাটবার, শিকল, কাছ, কর্কসীট, আংটা, কব্জা, রং, রশি, ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। জি আই সীট দিয়ে মোড়ানো কর্কসীটের বাক্সটি শক্ত ও টেকসই করার জন্য এর বাইরের দিকে একটি এঙ্গেল ও ফাট বারের তৈরি ফ্রেম বসিয়ে দেয়া হয় যাতে ট্রাকে উঠানো-নামানো ও পরিবহণের সময় বরফ বাক্স বা বাক্সের ভিতরের মাছ আঘাত না পায় বা ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। প্রয়োজনের তাগিদে ও সুবিধামতো বাণিজ্যিক পরিবহণকারীরা ডিজাইনে কিছুটা পরিবর্তন করে নিয়েছেন। ময়মনসিংহ-নেত্রকোণা অঞ্চলে ব্যবহৃত হয় ৩৬ ী ২৪ ী ২০ ইঞ্চি সাইজের বাক্স । আবার সাতক্ষীরা অঞ্চলে ৩৮ ী ২৮ ী ২৫ ইঞ্চি, ভৈরব অঞ্চলে ৩৬ ী ২৪ ী ২২ ইঞ্চি বা ২৪ ী ১৮ ী ১৮ ইঞ্চি সাইজের বাক্স ব্যবহৃত হচ্ছে। বড় বাক্সে শীতকালে বরফ বাদে ২৫০-২৮০ কেজি এবং গরম কালে ২০০-২২০ কেজি মাছ পরিবহণ করা যায়। ছোট বাক্সে শীতকালে বরফ বাক্সে ১২০-১৫০ কেজি এবং গরমকালে ৮০-১২০ কেজি মাছ পরিবহণ করা হয়।

আফ্রিকায় প্রযুক্তিটি ছড়িয়ে পড়ার সম্পর্কে ড. নওশাদ বলেন, বরফ বাক্সের সহজ ও সস্তা প্রযুুক্তির খবর নানা সময়ে বিভিন্ন জার্নাল, সাময়িকী, সংবাদ মাধ্যম ও ইন্টারনেট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হলে জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা- ”ইউনিডো” এর প্রধান কার্যালয় ভিয়েনা থেকে মৎস্য শাখার প্রধান কর্মকর্তা আমাকে টেলিফোন করে পূর্ব-আফ্রিকার রিপাবলিক অব মালায়ির মৎস্য ভ্যালুচেইন উন্নয়নের ওপর ৫ বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়, যেখানো তার উদ্ভাবিত বিভিন্ন প্রযুক্তি, যেমন এফ এ ও আইস বক্স, এফ এ ও ট্যাংক আইস বক্স, বিদ্যুৎবিহীন হিমাগার, বিষমূক্ত শুটকি তৈরির জন্য রিং-টানেল এবং বক্স-টানেল, বর্ষাকালে শুটকিকরণ প্রযুক্তি, ইত্যাদি প্রচলন ঘটানো যাবে। ড. নওশাদ মালায়ি মৎস্য বিভাগের সহায়তায় সরেজমিনে কাজ করে ভ্যালুচেইন উন্নয়ন প্রকল্পটি তৈরি করে জমা দেয়ার পর আবার ইউনিডো থেকে পশ্চিম আফ্রিকার গাম্বিয়ার জন্য আরো অন্তত দুটি প্রকল্প তৈরিতে সহায়তা করে সরাসরি হাতে কলমে প্রশিণ প্রদানের মাধ্যমে এফ এ ও আইস ব্ক্স, এফ এ ও ট্যাংক আইস বক্স ও বিদ্যুৎবিহীন হিমাগার তৈরিতে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। ইতোমধ্যে ওই সকল সস্তা ও কার্যকরী প্রযুক্তিগুলি গাম্বিয়ার মৎস্য বিভাগ ও দরিদ্র মৎস্যজীবীদের নিকট বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

মাছ বাজারজাত ও প্রক্রিয়াজাতকরনে নিজের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সম্পর্কে ড. নওশাদ আলম বলেন, সহজলভ্য ও সস্তা বস্তু দিয়ে তৈরি বলে টেকসই বরফ বাক্সগুলি দেশে বিপুল জনপ্রিয়তার পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়নশীর দেশেও জনপ্রিয়তা লাভ করবে বলে আশা করা যায়। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মাছ সংরণ ও পরিবহণের এই প্রযুক্তিটি দেশে আরো ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়ে মাছের আহরণ-পরবর্তী পচন আরো কমে গিয়ে বাংলাদেশী জনগণের আমিষের চাহিদা বহুলাংশে মেটাতে সক্ষম হবে।

লেখকঃ

শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ মোবাইল- ০১৭২১ ৫১২৫৪০

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.