জাতীয় রাজনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে আঞ্চলিক রাজনীতির কাছে

0

সাইফুল উদ্দীন, রাঙামাটি প্রতিনিধি:বিগত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও পাহাড়ের সবচে ‘প্রেস্টেজিয়াস’ আসন হিসেবে বিবেচিত, পার্বত্য রাঙামাটি আসনে প্রধান দুই জাতীয় রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপিকে যে আবারো বেকায়দায় ফেলতে যাচ্ছে, তা এখনই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সেই ইঙ্গিতই দিয়ে গেলো। যদিও জাতীয় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের ব্যাপক প্রস্তুতির মধ্যেও এখনো চুপচাপ আঞ্চলিক দলগুলো। তবে জাতীয় রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি চষে বেড়াচ্ছে রাজনীতির মাঠ।  ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ১ লক্ষ ১৫ হাজার ১২ ভোট পেয়ে বিজয়ী নৌকার কাছে মাত্র ৫১ হাজার ৮৩৩ ভোট পাওয়া আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতির ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ উষাতন তালুকদার দৃশ্যত: পাত্তাই পায়নি। সেই নির্বাচনে ৫৬ হাজার ২৪৯ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন বিএনপির ‘বিপদ পাড় হওয়া’র প্রার্থী মৈত্রী চাকমা। আর নির্বাচনে ‘না’ প্রতীকে ৩২ হাজার ৬৮ ভোট নিয়ে নিজেদের শক্ত অবস্থানের কথাই জানান দিয়েছিলো আরেক আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট( ইউপিডিএফ)।

মাত্র ৫ বছর পরেই ২০১৪ সালে উল্টে যায় ভোটের পুরনো হিসাব নিকাশ। সেই নির্বাচনে সারাদেশে আওয়ামীলীগের ভূমিধস বিজয়ের মধ্যেও রাঙামাটিতে হেরে বসে নৌকার হেভিওয়েট প্রার্থী ও নির্বাচনকালিন সরকারের মন্ত্রী দীপংকর তালুকদার! আগের নির্বাচনে যার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন, সেই উষাতনের কাছেই ১৮ হাজার ৮৫২ ভোটে হেরে যান তিনি। উষাতন তালুকদার পান ৯৬ হাজার ২৩৭ ভোট, দীপংকর তালুকদার পান ৭৭ হাজার ৩৮৫ ভোট।

অথচ ওই নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণই ছিলো না, ছিলো না ইউপিডিএফ। তবে আরেক আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা)’র সভাপতি সুধাসিন্ধু খীসা নির্বাচনে অংশ নিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পান।

এখন সময় বদলেছে, ২০০৮ সালের পর আরো ১০ বছর পেরিয়ে আবারো নির্বাচন সমাগত। জাতীয় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপির তৎপরতা চোখে পড়ছে ইতোমধ্যেই। পুনরায় বিজয়ী হতে মরিয়া আওয়ামীলীগের দীপংকর তালুকদার চষে বেড়াচ্ছেন এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। ‘অস্বাভাবিক’ কিছু না হলে আওয়ামীলীগে আবারো দীপংকরই প্রার্থী একথা বলে দেয়াই যায়।  তাকে ছাড়া কাউকে মানবেও না দলটির তৃণমূল। নিয়মিত উপজেলা, ইউনিয়ন সফর করা দীপংকর সাবেক মন্ত্রী হলেও এখনো সরকারি বেসরকারি কিংবা দলীয় কর্মসূচির অপরিহার্য অতিথি।

ক্ষমতাসীন দলের একক নেতা হওয়ায় প্রশাসনও তাকে সমঝে চলে। দলেও তৈরি হয়নি তার কোন প্রবল প্রতিপক্ষ। ফলে আগামী নির্বাচনেও নৌকার ঝান্ডা তার হাতেই থাকবে, এমনটাই ধারণা বিশ্লেষকদের। দলে দু’চারজন তার বিরুদ্ধবাদি থাকলেও তারা হালে পানি পাবেন না। ফলে মাঠ চষে বেড়ানো ঝানু এই রাজনীতিক নিজ দল বা বিএনপি নন, আঞ্চলিক দলকেই নিজেদের প্রধান প্রতিপক্ষ মেনে মাঠে ময়দানে বক্তৃতা বিবৃতিতে, নিশানা তাদের দিকেই জারি রেখেছেন। চালিয়ে যাচ্ছেন নিজস্ব কর্মসূচি। বিগত নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অবৈধ অস্ত্রকেই প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন গত চারবছর ধরেই। এক্ষেত্রে তিনি কিছুটা সফলও।

ফলে পুনর্বাসিত বাঙালিদের মধ্যে নৌকার জনপ্রিয়তা যেমন তিনি বাড়াতে পেরেছেন, তেমনি আবার শত প্রতিকূলতার মধ্যেও জাতীয় রাজনীতি করা পাহাড়িদের মধ্যেও তৈরি করতে পেরেছেন একটি সক্রিয় সমর্থকগোষ্ঠি। আর এই ক্ষেত্রে নিজ দল ক্ষমতায় থাকা এবং জেলা পরিষদের সকল জনগোষ্ঠির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারাটাই তার জন্য সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। অন্যদিকে পাহাড়িদের একটি অংশের তার ‘অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি’র প্রতি এলার্জি ও অপপ্রচার এবং লংগদুতে নিরীহ পাহাড়িদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা তার কিছুটা হলেও ক্ষতি করেছে। তবে সেই চ্যালেঞ্জ জয়ী হতে মরিয়া তিনি ও তার দল।

জয়ের ব্যাপারে আশাবাদের কথা জানিয়ে রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মো: মুছা মাতব্বর জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগেই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করলে আমরাই বিজয়ী হবো। ‘বিএনপি নয়, আঞ্চলিক দলই প্রধান চ্যালেঞ্জ’-এটা মেনে নিয়ে তিনি বলেন, গতবার তারা যেটা করেছে, এবার তা পারবে না। এবং দাদা দীপংকর ছাড়া অন্য কাউকেই প্রার্থী করার সম্ভাবনা শূণ্যভাগ বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন তিনি। তবে জোট রাজনীতি কিংবা জাতীয় রাজনীতির সমীকরণের কথা বলে কোন আঞ্চলিক দলের কাউকে নৌকার প্রার্থী করা হলে সেটা রাঙামাটি আওয়ামীলীগ মানবেনা বলেও জানিয়ে দেন তিনি। এমন সম্ভাবনার কথাও মানতে রাজি নন, প্রভাবশালী এই রাজনীতিবিদ।

নির্বাচনের ব্যাপারে প্রার্থী ও প্রচারণায় এখনই যতটা প্রস্তুত আওয়ামীলীগ, ঠিক ততটাই এলোমেলো ও অস্বস্তিতে বিএনপি। ১৯৯১ সালের পর কোন নির্বাচনেই দলটির কোন প্রার্থী একাধিকবার নির্বাচন করতে পারেনি। ফলে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই ধার করা বা উড়িয়ে আনা কিবাং ঘরের বউকে প্রার্থী দিয়েই নির্বাচনে অংশ নেয়া দলটির এবারেও কে প্রার্থী হবেন জানে না কোন নেতাকর্মীই।

ফলে কখনো সাবেক সামরিক কর্মকর্তা লে: কর্নেল (অব.) মণীষ দেওয়ান, কখনো সাবেক যুগ্ম জেলা জজ এডভোকেট দীপেন দেওয়ান আবার কখনো জেলা বিএনপির সভাপতি হাজী মো: শাহ আলম আসেন আলোচনায়। এই তিনজনের বাইরে থেকেও চতুর্থ কাউকে উড়িয়ে এনে প্রার্থী করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে পারছেন না তৃণমূল কর্মীরা।

রাঙামাটি জেলা বিএনপিতে গ্রুপিং এবং বিরোধ কাটিয়ে ২০১৫ সালে নতুন করে সংগঠিত হয়েছিলো দলটিতে জেলা কাউন্সিলে দীপেন দেওয়ানকে পরাজিত করে মো: শাহ আলমের সভাপতি হওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু পরাজিত দীপেন দেওয়ান কেন্দ্রীয় কমিটির পদ পাওয়ায় এবং তার এককালের ‘মিত্র থেকে শত্রু; হওয়া সাবেক পৌর মেয়র সাইফুল ইসলাম ভূট্টোর আবার ‘শত্রু থেকে মিত্র’ হওয়ায় হালে পানি পায় জেলা বিএনপি কার্যালয়েই দীর্ঘদিন অবাঞ্ছিত থাকা দীপেন ও তার অনুসারিরা। ফলে  সম্প্রতি আবারো নড়চড়ে বসেছে দীপেন গ্রুপ। অন্যদিকে এদের কয়েকজনকে বাদ দিলে পুরো বিএনপি ও তার সহযোগি সংগঠনসমূহ ঐক্যবদ্ধই আছে। সম্প্রতি সদস্য সংগ্রহ অভিযানে একাধিক উপজেলায় দুটি গ্রপই আলাদা আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করেছে। মে দিবসে দুই গ্রুপের বিরোধে কোন পক্ষই কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। তবে বিরোধের কথা মানতে নারাজ জেলা বিএনপির সভাপতি হাজী মো: শাহ আলম।

তিনি বলেন, আমাদের দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা আছে, বিরোধ নেই। মনীষ, দীপেন কিংবা তিনি নিজে, যেকোন একজন মনোনয়ন পেতে পারেন, এমন সম্ভাবনার কথা জানিয়ে এই নেতা বলেন, আমরা তিনজনই মনোনয়ন চাইব, দল যাকে যোগ্য মনে করবে তাকেই দিবে এবং আমরা সবাই তার জন্যই কাজ করব।

তবে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে দেখা গেছে, তাদের বেশিরভাগই মনীষ দেওয়ানকে মনোনয়ন দেয়ার পক্ষে এবং মনীষ না হলে, বিকল্প হিসেবে শাহ আলমকেই চাইছেন,আবার দীপেনের মনোনয়ন পাওয়াও বিচিত্র নয়। যেহেতু আওয়ামীলীগ ও জেএসএস দুদলই পাহাড়ী প্রার্থী দিচ্ছে সেহেতু পুনর্বাসিত বাঙালিদের ভোটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাঙালি প্রার্থী হিসেবে শাহ আলমের কথাই বলছেন অনেকেই। আবার সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত জীবনে সজ্জন হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা মণীষ দেওয়ানকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী হিসেবে ভাবছে দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। আবার রাজনীতির সমীকরণে দীপেন দেওয়ানের মনোনয়ন পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

আবার ২০০১ সালে উড়িয়ে এনে বিজয়ী হওয়া মনিস্বপন দেওয়ানকেও আবার এনে আবার প্রার্থী করার ভাবনাও আছে অনেকের মধ্যেই। ফলে সবমিলিয়ে প্রার্থী নিয়ে এখনো চতুমুর্খী অবস্থানে জেরবার দলটি। তবুও যদি মনীষ-দীপেন-শাহ আলম কিংবা মনিস্বপন, এই চারজনের যাকেই প্রার্থী করা হোকনা কেনো,দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে না নামে, তবে পাহাড়ের নির্বাচনে ‘অভাগা দল’টি এবারের নির্বাচনে অন্তত: পার্বত্য রাঙামাটি আসনে খালি হাতেই ফিরবে।

এক কালের সশস্ত্র সংগঠন, চব্বিশ বছর স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম দাপিয়ে বেড়ানো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি  (জেএসএস) ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি সাক্ষরের মাধ্যমে অস্ত্র সমর্পন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। আসার পর ২০০১ সালের প্রথম নির্বাচনই বয়কট করে দলটি।

শুধু তাই নয়, স্থানীয় নির্বাচনেও দলটির অংশগ্রহণ চোখে পড়েনি। ২০০৬ সালের বাতিল হয়ে যাওয়া নির্বাচনে প্রার্থী দিয়ে প্রথম ভোটের মাঠে নামে দলটি। ২০০৮ সালে দলের প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় নেতা উষাতন তালুকদার ভোটের মাঠে নেমেই পরাজয় বরণ করেন নৌকার প্রাথী দীপংকরের কাছে। তবে মাত্র ৫ বছর পরেই সেই পরাজয়ের শোধ নেন তিনি ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই। বর্তমানে আগের চেয়েও শক্ত ও মজবুত দলটির সাংগঠনিক কাঠামো। তার উপর পাহাড়ের তিন আঞ্চলিক দলের সাম্প্রতিক বিরল সমঝোতা তাদের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসায়, গত বছর অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এর সুফল পায় দলগুলো।

এরই ধারাবাহিকতায় এবারো তার একক প্রার্থী নিয়ে সংসদে যেতে বদ্ধপরিকর বলেই জানা গেছে দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে। ইতোমধ্যেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এই তিন দলের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে বলে জোর গুঞ্জন। বাতাসে পাওয়া সেই তথ্য হালেও পানি পাচ্ছে বেশ। সেই হিসেবে রাঙামাটিতে জনসংহতি সমিতিকে ছেড়ে দিচ্ছে ইউপিডিএফ,বিনিময়ে খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফকে ছাড় দিচ্ছে দুই জনসংহতি, এমন তথ্যই জানাচ্ছে, তিন সংগঠনের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো। এমনটা যদি শেষাবধি ঠিক হয়,তবে রাঙামাটিতে খুব সহজেই নির্বাচনী বৈতরণী পাড় হতে পারে জেএসএস, খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ এর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

নির্বাচন এবং রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে বরাবরই ‘নীরব’ থাকা আঞ্চলিক দলগুলোর নির্বাচন সম্পর্কিত বক্তব্য এবং বাস্তবতার মধ্যেও মিল খোঁজা বোকামিই। তবে জনসংহতি সমিতির মুখপাত্র সজীব চাকমা জানালেন, এখনো নির্বাচন নিয়ে কথা বলার মতো সময় আসেনি, সময় আসলে বলব। তবে যেহেতু আমরা নির্বাচনমুখি দল এবং বিগত সংসদেও নির্বাচিত হয়েছি সুতরাং অবশ্যই নির্বাচনে আমাদের একটা স্পষ্ট অবস্থান থাকবে এবং তা ইতিবাচকই।’

জাতীয় প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র সাথে আঞ্চলিক দলগুলোর সমর্থিত একক প্রার্থীর লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হবে রাঙামাটি আসনের বিজয়ী সংসদ সদস্য। এদের বাইরে কেউ কেউ হয়তো নির্বাচনে অংশও নিবেন, পরাজিত হবে এবং ফিরে যাবেন পুরনো কাজে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.