চট্রগ্রামে গুডস হিল : শেষ হচ্ছে সাকার সাম্রাজ্য!

0

জুবায়ের সিদ্দিকী : নগরীর গুডস হিল। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পারিবারিক বাংলো। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাস জুড়ে নির্যাতন চলে নানা জায়গা থেকে ধরে আনা মুক্তিসেনাদের। মুক্তিকামী বাঙ্গালীকে নির্যাতনের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে নগরীর গণিবেকারী এলাকায় সেই গুডস হিল এখনও দাঁড়িয়ে আছে। চট্টগ্রামের মানুষ এখনও সেই গুডস হিলের সামনে দিকে হাঁটতে গিয়ে অজানা আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারও কারও কাছে গুডস হিল এক বধ্যভুমি। তাদের দাবি, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার বাবা মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরীসহ পরিবারের প্রায় সব সদস্যই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাসহ হত্যা, নির্যাতন ও গুমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গত ২৮ জুলাইয়ে আপিলের রায়ে সেই বাড়িটি এখন পর্যন্ত নীরব, নিস্তব্দ।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছাড়াও তার অপর তিন ভাই গিয়াসুদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা সেখানে পৃথক ভবনে থাকতেন। তবে বর্তমানে সেখানে কারা রয়েছেন সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি। একটি সুত্র জানায়, সালাউদ্দিন কাদের যুদ্ধাপরাধের চুড়ান্ত রায়কে ঘিরে বাড়ি এবং এর আশপাশে মাসখানেক আগে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। মুল ফটকের সামনে ও পুলিশের সশস্ত্র সদস্যদের অবস্থান দেখা গেছে।

একজন জানালেন ক্যামেরা বসানোর পর থেকে ভবনের বাসিন্দারা সিসি ক্যামেরায় সতর্ক চোখ রাখেন। তবে একাত্তরের টর্চার সেল নামে পরিচিত এই বাড়িতে এখন কারা থাকছেন সে ব্যাপারে মুখ খুলতে চাননি দশ বছর ধরে চাকরী করা কর্মচারী। গত পাঁচ বছর ধরে গুডস হিলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আবদুল হাই জানান, ভেতরে কেউ নেই। একজন প্রবীন মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ’একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্নস্থান থেকে পুরুষ মহিলাদের ধরে এনে অবর্ননীয় নির্যাতন চালানো হতো এই অভিশপ্ত গুডস হিলে। গভীর রাতেও শোনা যেত নির্যাতিত মহিলাদের চিৎকার আহাজারী’।

’আমার না হলে, ফাঁসি কারো হবে না’।২০১৩ সালের ১৭ জুন যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলাকালে নিজের সাফাই সাক্ষী দেয়ার সময় এমন মন্তব্যই করেছিলেন মানবতা বিরোধী মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বিএনপি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। এর আগে ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর গ্রেফতার হওয়ার আগে ’আতঙ্কের মধ্যে এতোটা নির্ভার কিভাবে আছেন’ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ’ধর্ষণ যখন নিশ্চিত, তখন তা উপভোগ করায় শ্রেয়’। এভাবে বেফাঁস মন্তব্য করে বিভিন্ন সময়ে প্রায় সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসতেন এ সাকা চৌধুরী।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সাকার করা এ বেফাঁস মন্তব্যগুলো লুফে নিয়েছিল মিডিয়া। যেমন- বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিভিন্ন কর্মকান্ডে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নীরব সমর্থনের ব্যাপারে বলেছিলেন, ’আগে কুকুর লেজ নাড়াতো, এখন লেজ কুকুরকে নাড়ায়’। নবম সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা ’নেই’ উল্লেখ করেন সাকা চৌধুরী। অসত্য তথ্য দেয়ায় নির্বাচনি আইন অনুযায়ী তার সংসদ সদস্যপদ খারিজের উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন। সে সময় নির্বাচন কমিশনকে ’গমচোর’ আখ্যা দেন তিনি। চলনে বলনে ঊদ্ধত্যপুর্ন, দোর্দন্ড প্রতাপশালী সাকা চৌধুরী এখন নি:শেষ প্রায়।

ট্রাইব্যুনালের রায় আপীল বিভাগেও বহাল থাকায় ধ্বংস হতে চলেছে তার সাম্রাজ্য।
১৯৭১ সালে অবস্থান ছিল হানাদারদের দোসর হিসেবে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় হত্যা, লুটতরাজসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকায় আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেন। ৭১ এর আগষ্ট মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে পাড়ি জমান লন্ডনে। দেশে ফেরেন ৭৪ এর এপ্রিলে। যোগ দেন রাজনীতিতে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে গঠন করেন ক্যাডারভিত্বিক রাজনৈতিক দল এনডিপি। এক পর্যায়ে বিভিন্নস্থানে এনডিপি ক্যাডারদের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন-রাহাজানী বিভিন্ন নানা অপকর্মের খবর প্রচার হতে থাকে মিডিয়ায়।

এর পর ১৯৯১ সালে নিজ দল এনডিপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এর আগে ১৯৭৯ সালে মুসলিম লীগ ও ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য হন। পরবর্তীতে ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে বিএনপির ব্যানারে সাংসদ হন তিনি। অভিযোগ আছে, এনডিপি গঠনের পর নিজ এলাকা রাউজানে ও শহরের কয়েকটি এলাকায় সাকার পরোক্ষ মদদে গড়ে উঠে সন্ত্রাসী বাহিনী। এ বাহিনীর হাতেই রাউজানে প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হন ওই সময়ের প্রভাবশালী ছাত্রলীগ নেতা বাবর-মুজিব। সেই ধারা চলে পরবর্তী দুই দশক। ৯১ সালে আলমগীর নামে ছাত্রলীগ কর্মী হত্যা মামলার প্রধান আসামী ছিলেন এই সাকা। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, প্রতিহিংসামুলক রাজনৈতিক কারনে রাউজানে একাধিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে সাকার পরোক্ষ সমর্থনে। ২০০১ সালে নগরীর রহমতগঞ্জের অভিশপ্ত সেই গুডস হিলের সামনে আবদুল্লাহ আল নোমান সমর্থিত ছাত্রদল নেতা নিটোলকে সাকার ক্যাডাররা হত্যা করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

নব্বই দশকের সাকা সমর্থিত ক্যাডার ফজল হক, বিধান বড়ুয়া, জানে আলম, আবু তাহের, রমজানসহ একাধিক সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে গড়ে উঠা বাহিনীর হাতে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি এলাকায় খুন, ডাকাতি, অপহরন, ধর্ষন সহ নানা অপরাধ ঘটতে থাকে। এ নিয়ে শুরু হয় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সাকা সমর্থিত সন্ত্রাসীদের দ্বন্দ্ব। এভাবে দুই দশকে খুন হয় ২০ জনেরও বেশি। শুধু রাজনৈতিক কারনে নয় পারিবারিকভাবেও প্রভাবশালী ও বিত্তশালী ছিলেন সাকা চৌধুরী। সাকা তারঁ ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করেন কিউসি গ্রুপের ব্যানারে। এ গ্রুপের রয়েছে শিপিং ব্যবসা, কন্টেইনার হেন্ডেলিং, সিএন্ডএফ সহ বিভিন্ন ব্যবসা। মালিকানা রয়েছে ফোকাস মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড। এ প্রতিষ্টান থেকে আত্বপ্রকাশ ঘটেছিল ’সিএসবি টিভি’র। যেটির সম্প্রচার ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বন্ধ হয়ে যায়।

অভিযোগ উঠেছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত ছাত্র বিদ্রোহেও তার মদদ ছিল। অভিযোগ রয়েছে, ব্যবসার অন্তরালে সাকার কাজ কারবার ছিল আন্ডারওয়াল্ডে। ১৯৯৬ সালে তার মালিকানাধীন জাহাজ কিউসিটিল থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল অবৈধ স্বর্নের বার। যার তৎকালীন বাজার মুল্য ছিল আড়াই কোটি টাকা। ২০০৯ সালে ঋন খেলাপীর তালিকায় এসেছিল সাকার মালিকানাধীন ফোকাস মাল্টিমিডিয়া লিমিটেডের। তালিকায় যার অবস্থান ছিল ১৬১তম। টাকার পরিমান ১৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.