রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র ও জনপ্রতিনিধিদের রাজাকারতন্ত্র

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ রাজনীতি এখন পুঁজি ছাড়া ব্যবসার হাতিয়ার। সারাদেশে রাজনীতির মানচিত্রে এখন উত্তরাধিকারীর রাজনীতি চলছে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী বা জাতীয় পার্টিসহ ছোটবড় সব দলের চিত্র একইরকম।

এই দেশে যারা অতীতে এমপি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান, প্রশাসক, মেয়র, নেতা বা শীর্ষ নেতা ছিলেন। তাদের মৃত্যুর পর পরিবার ও স্বজনদের দখলে যাচ্ছে, রজানীতি, পদ-পদবী, এমপি বা মন্ত্রিত্ব। রাজনীতির ক্রমবর্ধমান পদচলায় তৃণমূল হয়ে পড়েছে কোণঠাসা। তাদের পথ যেন আগলে ধরেছে উত্তরাধীকার রাজনীতি। শীর্ষ নেতা বা এমপি-মন্ত্রির পুত্রকন্যা সহসা পেয়ে যাচ্ছেন পদপদবী। রাজনীতির সাথে তাদের কোন সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্বেও এরা পদ-পদবী আঁকড়ে ধরেছে। যার কারনে পারিবারিকতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। ছিটকে পড়ছে পরীশ্রমী ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা। একারনে ত্যাগীদের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছেনা।

অনেকে রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ছেন। দেশে রাজনীতির পরিবারতন্ত্র আগে মহামারীর মতো ছিলনা। বর্তমানে তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে রাজনীতিতে তৃণমূলের অধিকার যেন অল্প পরিসরে পরিধি ছোট হয়ে পড়েছে। শীর্ষ নেতাদের অনেকে বার বার ক্ষমতার হালুয়ারুটি ভোগ করছেন কিন্তু অন্যরা শুধু থালা বাটি নিয়ে ঘুরছেন। কোথাও কিছু ভাগে জুটছেনা।

আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো দলের শত শত নেতাকর্মী তৃণমূল পর্যায়ে পুরোপুরি অবহেলিত। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদলের হঠাৎ করে অবিশ্বাষ্য দ্রুততম সময়ে অঢেল অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠা এই শ্রেণির ব্যক্তিরা তাদের জৌলুসপূর্ণ বিলাসী জীবনাচার, উন্নত ও অহমিকাপূর্ণ আচরণে মানুষের কাছে সহজেই চিহ্নিত হয়ে যান। শর্টকাট পথে রাজনীতির লেবাসে সম্পদের মালিক হওয়া এই শ্রেনির মধ্যে কেউ কেউ সামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িত জনদরদী ও জনপ্রতিনিধি হওয়ার প্রয়াসী হন।

আবার কেউ কেউ স্কুল কলেজ মসজিদ মাদ্রাসা ধরনের কিছু প্রতিষ্ঠা করেন। কেউ বছর বছর বিশাল আকারের মেজবানীর আয়োজন করে হাজার হাজার মানুষকে আপ্যায়ন করেন এবং তাদের কেউ কেউ ঘটা করে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঈদের আগে জাকাতের টাকা-কাপড় বিতরণ করে জনগণকে তাদের বিত্ত-বৈভবের জানান দেন। আবার কেউ একাধিকবার ওমরা ও হজ্ব করে ধার্মিক সাজেন। এই শ্রেণির কিছু লোক ইউপি, উপজেলা এবং সংসদ নির্বাচনে লড়ার জন্য নগদ অর্থে জনসমর্থন আছে এমন দলগুলোর মনোনয়ন কেনার চেষ্টায় থাকেন।

মনোনয়ন কেনার প্রতিযোগীতায় কামিয়াবি হলে এবং নির্বাচনী লড়াইয়ে সফল হতে পারলে তারা আম জনতা তথা এদেরকে বিশাল নীরব জনগোষ্ঠীর মাথার উপর ছড়ি ঘোরান। রাজনীতির খাতায় নাম না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যেতে ক্লান্তিবোধ করেননা। রাজনীতির লেবাসে আজ যারা নানাভাবে অবৈধ আর্থিক পাহাড় গড়েছেন তাদের যেন কোন জবাবদিহীতা নেই।

কথায় বলে বারো রকম রাশি, বারো রকম মানুষ, বাস্তবে কি বারো রকম মানুষ নাকি ছত্রিশ রকম মানুষ তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। জীবনের এ পর্যায়ে এসে আশপাশের মানুষদের দেখি আর ভাবি তাদের বিচিত্র মনুষ্যত্ব নিয়ে।

চট্টগ্রামে ক্ষমতাসীনদলের রাজনীতি কোন কোন স্থানে পেশিশক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে। সেদিন একটি নিউজের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার দেখা হলে তিনি বললেন, “অবাজি ক্যান আছন, চাটগাঁ টাউন’ত ট্যায়া লই পদ-পদবী বেচাকেনা হয়, নেতা হয় ট্যায়ার বিনিময়ে ক’ডে গেলে শান্তি পাইয়ুম।”

চট্টগ্রামের রাজনীতির মাঠে হঠাৎ আওয়ামী লীগ হয়ে যাওয়ারা যেভাবে মাঠ দখল করছে, সেভাবে দখল করছে পরিবার তন্ত্র। এই পরিবার তন্ত্রের যাঁতাকলে জিম্মি হচ্ছে মানুষ। রাজনীতিতে শেষ বলে কোন কথা নেই। চট্টগ্রামে ক্ষমতাসীদলের রাজনীতিতে ডিগবাজী দেওয়া যেমন নেতার অভাব নেই। তেমনি অভাব নেই পরিবারতন্ত্র রাজনীতির রথি মহারথিদের। এরা আছে দাপটে।

ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে এদের অবস্থান। বিএনপিতেও এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়াতে ত্যাগীরা রাজনীতিতে নিস্ক্রীয় হয়ে পড়ছে। ঢাকায় বিএনপির উপদেষ্টা ছিলেন শিল্পপতি আব্দুল আওয়াল মিন্টু তার ছেলে করছে মেয়র নির্বাচন। সাবেক মেয়র মরহুম সাদেক হোসেন খোকার ছেলেও মেয়র প্রার্থী। শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে শেখ ফজলে নূর তাপসও মেয়র প্রার্থী।

আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর দীর্ঘ ২১ বছর দেশ শাসন করেছে জাতীয় পার্টি ও বিএনপি। সে সময়েও ত্যাগী ও পরিশ্রমি নেতারা বাদ পড়তেন। সব সরকারের আমলে ছিল পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি। এই ধারা থেকে আওয়ামী লীগও বাদ পড়েনি। এমনিতেই বিশাল একটি দল আওয়ামী লীগ। পদ-পদবী নিয়ে আছে প্রতিযোগীতা। এর মধ্যে বাঁধ সাধে পরিবারতন্ত্র। দেশে বৃহৎ দুটি দল পরিবারতন্ত্রের রাজনীতির গ্যাড়াকলে যেন আটকে আছে।

আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ এখন সারাদেশে আলোচিত ও সমালোচিত ঘটনা। রাজাকার, জামাতনেতা, জামাতের অর্থযোগানদাতারা এখন তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগের পদ-পদবী কিনছেন তারা। হয়ে উঠছেন বড়ো নেতাদের ঘনিষ্ট। এসব বিরোধী মতাদর্শীরা দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে দুর্নীতি, চোরাচালান, জমিদখল, নিয়োগ-বদলী, বাণিজ্য, লুটপাটসহ নানা কর্মকা-ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ১১ বছরে ৫৫ হাজার বিরোধী মতাদর্শী আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোতে অনুপ্রবেশ করেছেন। বিষয়টি দলের জন্য অশনি সংকেত। এক সময় যারা ফ্রিডম পার্টি, বিএনপি ও জামাত-শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, ২০০৯ সালের পর তারা দলে দলে সরকারী দলে যোগদান করা শুরু করেন। সংঘবদ্ধ হওয়ার লক্ষ্যেই স্বাধীনতা বিরোধী আদর্শের মানুষরা অর্থের বিনিময়ে ও নানা কৌশলে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের ছত্রছায়ায় আছেন, দলের গুরুত্বপূর্ণ পদও পেয়েছেন।

একই সঙ্গে অতীত অপকর্ম থেকে রেহাই পাওয়া, দলের মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করার টার্গেট নিয়েও তারা ক্ষমাতীসীন দলে যোগ দিয়েছেন। চট্টগ্রামে কোন কোন ক্ষেত্রে তারা আলাদা বলয় সৃষ্টি করে নিজস্ব প্লাট ফরম তৈরী করে বাহিনী গঠন করে আছেন বহাল তবিয়তে। কোন কোন স্বাধীনতা বিরোধী আদর্শের শীর্ষ নেতা বা জনপ্রতিনিধি গঠন করেছেন “সঞ্জিবনী শক্তির অমৃত সুধা”। যখন যেভাবে প্রয়োজন তখন সেভাবে ব্যবহার করেন। তৃণমূল আওয়ামী লীগের সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে যান বিরোধী মতাদর্শীরা।

উপজেলা থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ে পদ বেচা-কেনার ঘটনা অনেকটা ওপেন-সিক্রেট। অর্থের বিনিময়ে এসব পদে এসেছেন তারা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, অনুপ্রবেশকারীরাই আওয়ামী লীগের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা যে দলের ক্ষতি করতে এসেছিল তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে দলটি। এরা বারবার সরকার ও দলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার নতুন কৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়েই আওয়ামী লীগে ভীড়েছে। দলের হাই কমান্ড এখন তা অনুধাবন করছেন।

শুধু চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে নতুন করে আওয়ামী লীগ হয়েছেন বিভিন্ন দলের কমপক্ষে ২০ হাজার নেতাকর্মী। এদের মধ্য থেকে কাউন্সিলর, চেয়ারম্যানসহ এমনকি এমপিও হয়েছেন অনেকে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, বিভিন্ন দল থেকে ডিগবাজী দিয়ে এমপি বা জনপ্রতিনিধিরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বলয়।

এদের ডানে বামে সব সময় থাকেন রাজাকার ও তাদের বংশধররা। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলীয় নেতাদের উদ্দেশে স্পষ্ট বলেছেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এই দলে পরগাছাদের কোন জায়গা নেই। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতৃত্বে রাজাকার ও সুবিধাভোগীরা ভাল অবস্থানে রয়েছেন। তাদের দাপট ও প্রভাবপ্রতিপত্তি যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে অবিরাম অপ্রতিরোধ্যভাবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.