সরকারী দলের ফ্র্যাংকেনষ্টাইন দানব

জুবায়ের সিদ্দিকী : সরকারীদলের নাম ভাঙ্গিয়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ সহ অঙ্গ সংগঠনের অনেক পাতি নেতা থেকে শীর্ষ নেতাদের অনেকেই এখন বেপরোয়া। বৃহত্তর চট্টগ্রামে অনেক সংসদ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে আবার কোথাও আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে সন্ত্রাস. চাঁদাবাজি. টেন্ডারবাজি সহ জড়িত মাদক ব্যবসায়। কি শহরে, কি মফস্বলে একই চিত্র। প্রবাসীদেরও হতে হচ্ছে লাঞ্জিত। চাঁদা দিয়ে বাড়ি তৈরী করতে হয় নগরবাসীকে। এই সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে এসে অত্যাধিক বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সরকারদলীয় কতিপয় নেতা। এরা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। সাপ্তাহ কয়েক আগে চট্টগ্রামের পটিয়াতে এমপির ভাই বেধড়ক পিটিয়েছেন পুলিশের একজন দারোগাকে। পত্রিকায় এ নিয়ে সংবাদ প্রচারিত হলে এমপি দু:খ প্রকাশ ও তার ভাই দারোগার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। ভাটিয়ারীতে আওয়ামী লীগ নেতা ও মেম্বার চাঁদার ৫ লাখ টাকা চাঁদার দাবীতে দোকান ভাংচুর করেছে। এই গুনধর মেম্বারের বিরুদ্ধে কেউ কোন অভিযোগ করার সাহস পায় না এলাকাবাসী। এভাবে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারন মানুষ দেশের অনেক জায়গায়। হাইব্রীড়, বিএনপি-জামাত থেকে আসা ডিগবাজির খেলায় পারদর্শীরা ভিড় করেছে মন্ত্রী-এমপিদের বহরে। এদের কদর বেশি তাঁদের কাছে। চট্টগ্রামের এক সাবেক মন্ত্রীর এপিএস ছিলেন রাজাকারের ছেলে। এই এপিএস এখন কোটিপতি। হত্যা মামলার আসামী হলেও সে পার পেয়ে যায় ক্ষমতার দাপটে। আন্দোলন, সংগ্রামে যাদের কোন অবদান নেই, রাজপথে যাদের দেখা যায়নি কোনকালেও। যাদের ত্যাগ, শ্রম. মেধা ও মনন কোন কিছুই নেই তাদের গায়ে মুজিব কোট থাকে সবসময়। এদের দাপটই বেশি দলের অভ্যন্তরে। এরা মানুষকে মানুষ মনে করে না। টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিতে শীর্ষে আছে সরকারী দল।

দেশের রাজনীতির মানচিত্রে অস্থির অবস্তা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোন উন্নতি নেই। ক্ষমতাসীন নেতারা যেমন পুলিশ নির্ভর, তেমনি পুলিশও থেমে নেই। সাতকানিয়াতে গত সপ্তাহে ডলুব্রীজ এলাকা থেকে ফল ব্যবসায়ী মোবারক হোসেনকে দোকান থেকে ধরে নিয়ে যায় দারোগা কিবরিয়া। তিন হাজার নগদ নিয়ে আসামীকে নাশকতার মামলায় চালান দেয় পুলিশ। এভাবে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, পটিয়া ও ফটিকছড়িতে নিরহ লোকজনকে পুলিশের হয়রানী করার নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতাকর্মীর যোগসাজস। স্থানীয় নেতাদের অনেকেই এখন থানার দালাল। মানুষকে মামলায় দেয়া এবং মামলা থেকে উদ্ধার করাই তাদের কাজ। অভিযোগ রয়েছে, এভাবে সাতকানিয়াতে পুলিশ কোন কারন ছাড়াই মানুষকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে মামলায় জড়িয়ে আদালতে চালান দিচ্ছে। চরতি এলাকায় পুরুষ শুন্য হতে চলেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতাদের তৃমুখী দ্বন্দ্বে সাধারন মানুষ হয়রানী হচ্ছে। এসব কারনে এলাকার হিন্দু সুমলমান সর্বস্তরের মানুষ জামায়াত সমর্থিত চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। সাতকানিয়া থানার পুলিশ আটক বানিজ্য চালাচ্ছে এমন অভিযোগ সম্পর্কে সাতকানিয়া পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ জোবায়েরকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, মানুষকে হয়রানী না করার জন্য প্রশাসনকে বলা হয়েছে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও আশ্বাস দিয়েছেন। এরপরও কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলে আমরা অবগত হলে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এই চিত্র সাতকানিয়ায়। সাতকানিয়া জামায়াত অধ্যুষিত এলাকা হলেও যারা ক্রিমিনাল তারা থাকেন শহরে। গ্রামে যারা মাঠে, ঘাটে, দোকানে, ব্যবসায় কাজ করেন তাদের অধিকাংশ নিরহ প্রকৃতির। এদেরকে ধরে এনে পুলিশ জামায়াত শিবির দমনের নামে বানিজ্য চালাচ্ছে ফ্রি-ষ্টাইলে। এই থানার দারোগা কিবরিয়া তার নিজস্ব সোর্স নিয়ে অবাধে চালাচ্ছে বানিজ্য। দারোগার লাগাম টেনে ধরতে পারছে না পুলিশ কর্তৃপক্ষ। সাতকানিয়ার বিভিন্ন জনপদে মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঈদ পার্বন ও জানাজা পড়তে যাওয়া ছাড়া অনেক পুরুষ বাড়িতে যেতে ভয় পায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের কতিপয় নেতা এখন রিতিমত পুলিশের দালালীতে নেমেছে। এতে করে ব্যক্তিগত বিরোধের জের ধরে হিংসা চরিতার্থ হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারীদলের অভ্যন্তরে নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লেগে আছে। চট্টগ্রামের উন্নয়নের জোয়ার প্রবাহিত হচ্ছে গলাফাটিয়ে সরকার ও সরকারীদল দাবী করলেও বাস্তবে কিছুই নেই। প্রকৃত চিত্র হচ্ছে মন্ত্রী-এমপি ও তাদের চামচা চাটুকাররা লুটেপুটে খাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে উড়াল সেতু, পার্ক সহ নানা কর্মকান্ড চালালেও নগরীতে এক ঘন্টার বৃষ্টিতে শহর ডুবে যায় কোমর পানির নিছে। এর প্রতিকারে মন্ত্রী-এমপিদের কোন সমন্বিত পদক্ষেপ নেই। সব দায়িত্ব যেন সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের? আজব কারবার। জনগনের ভোট নিয়ে নির্বাচিত এমপিরা গাড়িতে পতাকা তুলে ঘুরে বেড়াবেন, জলাবদ্ধতা হলে বলবেন কর্পোরেশন কি করে? ব্যক্তিগত ভাবে শহরের এমপি-মন্ত্রীরা নিজেদের উদ্যোগে এলাকার উন্নয়নে কি করেছেন তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গোটা শহর কার্যত অরক্ষিত। কর্নফুলীতে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ৫-৬ ফিট জোয়ার বাড়লে গোটা শহর থাকবে পানির নিচে। নগর রক্ষা বাঁধ নিজেই অরক্ষিত। যে বন্দর হাজার কোটি টাকার রাজস্ব যোগান দেন প্রতিমাসে, সেই বন্দরের উন্নয়নও নেই। এমপি, মন্ত্রী, মেয়র, নেতা পাতিনেতা সবাই যেন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। নগরবাসীর দুর্ভোগ দুর্দশার চিত্র তারা চোখে দেখে না। মানুষের কান্না তাদের কানে যায় না। ভোটের সময় এলে এদের চেহারা পাল্টে যায়। হাতে পায়ে ধরে ভোট প্রার্থনায় করিতকর্মা তারা বেমালুম ভুলে যায় ক্ষমতায় গিয়ে। এক এমপির কাছে তার এলাকার একজন আওয়ামী লীগ কর্মী গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত কাজে। এমপি দেখে বললেন,’ কিল্লাই আইস্যদে, কার পোয়া, বাড়ি হড়ে বাঁজি! এবার কর্মী বলেন,’ কেন আমাকে চেনেন না! আমি তো কাজ করেছি দীর্ঘদিন আপনার সাথে। লজ্বিত এমপি এবার বলেন, ’কাহিনী ন কই, কিল্লাই আইস্যদে কইপালা বাজি।

চট্টগ্রামে সরকারী সকল দপ্তর, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্টানের সকল টেন্ডার নিয়ন্ত্রন করেন এমপি ও তাদের চেনাজানা কর্মীরা। মফস্বলের চিত্র অনেক স্তানে ভয়াবহ। এমপি সহ শীর্ষ অনেক নেতার নির্দেশ বা আদেশ ছাড়া থানায় মামলা নেওয়া, না নেওয়া সহ আসামী ধরা বা ছাড়া কোনটাই হয়না। হাইব্রীড় নেতা ছাড়াও শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা মোবাইল রিসিভ করেন না। বাস বা টেম্পুর যাত্রী ছিলেন এই তো সেদিন! এখন দামী গাড়ি হাঁকান। এক কেজি লইট্যা মাছ কেনার টাকা যাদের পকেট ছিল না তারা এখন লাঞ্চ না ডিনার সারেন রেষ্টুরেন্টে। বস্তিতে থাকলেও এখন দামী ফ্ল্যাটে তাদের বসবাস। ক্ষমতার মোহগ্রস্ত হয়ে দোর্দন্ড দাপটে ফ্্র্যাংকেনষ্টাইন দানবের রুপ নিয়ে অনেক জনপ্রতিনিধি ও তাদের চামচারা গড়ে তুলেছে মগের রাজ্য। এসব দানবের পোষ্যরাও নিয়ন্ত্রন করছে একেক এলাকা। সরকারের ভাবমুর্তি বিনষ্ট হচ্ছে চরমভাবে। গুটিকয়েক মানুষের জন্য সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। রাজনীতির মানচিত্রে এসব কিটপতঙ্গ কিভাবে যে সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজি সহ নানা অপকর্ম চালাচ্ছে তার ফিরিস্তী পত্রিকায় অহরহ প্রকাশিত হচ্ছে। মানুষের ভোটে নয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে অটোপাস মন্ত্রী-এমপি-মেয়ররা এখন ডেমকেয়ার। এদের চারপাশা চামচা চাটুকারদের ভিড়। এসব চাটুকারদের কারনে ফরিয়াদীর ফরিয়াদ শুনার সময় হয়না তাদের। সরকারী দলের নেতাদের ও এমপি মন্ত্রীর চামচা চাটুকারদের দৌরাত্ব্য এখন সর্বত্র। এমপি-মন্ত্রীদের ঘিরে একটি বলয় সৃষ্টি করে ফায়দা লুঠার সাথে সাথে অপকর্ম চালাচ্ছে। ক্ষমতায় মোহগ্রস্ত হয়ে এসব চামচা ও চাটুকাররা দিনের পর দিন সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির পাশাপাশি ভুমি দখল, বদলী বানিজ্য, নিয়োগ বানিজ্য, টেন্ডারবাজি, খুনোখুনি সহ নানা অপরাধ ঘটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে তারা। সরকারীদলের ছত্রছায়ায় দলের অঙ্গসংগঠনগুলোতে বখাটে, মাস্তান, ক্যাডার, মাদকাষক্ত,শ্রেনীর লোকজন ও জামাতের ক্যাডাররাও ভিড় করছে। সুষ্টধারায় রাজনীতি থেকে দেশের রাজনীতির অশনি সংকেত সাধারন জনগন অনুধাবন করতে পারছে। জনপ্রতিনিধিরা যেন জনগনের সেবায় নিয়োজিত নেই তা জনগনও বুঝতে পারছে। সরকার কোটি কোটি টাকার উন্নয়নের ফিরিস্তি দিলেও বাস্তবে হচ্ছে নগন্য। সরকারী দলের খাই খাই ভাব উন্নয়নের বারোটা বাজাচ্ছে। জলাবদ্ধতা, যানজট, নিরাপত্তাহীনতা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরন, ভুমি দস্যুতা সহ সামাজিক অপরাধ দিন দিন বাড়ছে। এসব অপরাধ দমনে সরকার লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে নগরজীবনে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বার বার ব্যাহত হচ্ছে।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.