পরী

0

                                                                                রাজিউল হাসান

অনেকক্ষণ হয় বিছানায় গা এলিয়ে দিলেও ঘুমের দেখা মেলেনি এখনো। এপাশ-ওপাশ করেই কেটে যাচ্ছে সময়। ঘুমানর আগে প্রতিদিনই ঘরটাকে আমি ঘুটঘুটে অন্ধকার বানিয়ে নেই। আবছা আলোতেও আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগে এ সময়। অন্ধকার আমার ভিষণ অপছন্দের হলেও এই একটা সময় আলো বড্ড অসহ্য লাগে।

রাত ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। ঘুম না আসায় বিরক্তির মাত্রাটাও তাই পারদ বাড়িয়ে চলেছে। মাঝে মধ্যেই কারণ ছাড়া এমন হয়। তখন সারারাত এপাশ-ওপাশ করে সকালে অফিস গিয়ে সারাদিন ঝিমাতে হয়। কাজের সময় ঝিমানো বড্ড অসহ্যকর একটা বিষয়। আর এমন দিনেই দেখা যায় কাজের চাপ একটু বেশি থাকে কিংবা বসের মেজাজ চড়ে থাকে।

হঠাৎ ঘরের দরজাটা ক্ষীণ একটু আর্তচিৎকার করে ফাঁক হতে শুনলাম। বাতাসের কারণে এমনটা হয়েছে বুঝতে পেরেও শিরদাঁড়া বেয়ে কেমন একটা শীতল প্রবাহ বয়ে গেল। মনে হল, খুব সন্তর্পনে ঘরে কেউ ঢুকেছে। অন্ধকারে চোরের ভয় যতো না, তার চেয়ে বেশি অশরীরির ভয়। এই জীবনে অশরীরি দেখার চেষ্টা কম করিনি। দাদাবাড়িতে কাছের জঙ্গলটায় নাকি গভীর রাতে জ্বিন-পরীর দেখা মেলে। কলেজে পড়ার সময় খেয়াল করে কোনো এক অমাবস্যার রাতে সারারাত জঙ্গলে গিয়ে বসেছিলাম। কিন্তু খুব সম্ভবত আমাকে অশরীরির পছন্দ না। তাই দেখা পাইনি। জামালপুরে আমাদের বাসাটা যেখানে, তার কাছে একটা মৃতপ্রায় নদী আছে। নাম ঝিনাই। ওই নদীটার ধারেও কখনো ভোর সকালে, আবার কখনো গাঢ় সন্ধ্যায় একা পায়চারি করেছি। এ জায়গাটা নিয়েও জনশ্রুত আছে। কিন্তু দেখা পাইনি। তবু আবছা অন্ধকারে অশরীরির কথা উঠলে কিংবা মনে পড়লে গা ছম ছম করে ওঠে। ছোটবেলা থেকে মা-দাদীদের কাছে ভূত-প্রেত-জ্বিন-পরীদের গল্প শুনে বেড়ে ওঠার কুফল এটা। বহিঃবিশ্বের ছেলেমেয়েরা শিশুকাল থেকে কোন গল্প শুনে বড় হয় জানা না থাকলেও, আমাদের দেশের সিংহভাগ যে পারিবারিকভাবে ভয়ের অনুশীলন করে তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

‘সাব, কি ঘুমাইয়া পড়ছেন?’

কে, আমার ঘরে কে? পাশের রুমের মধু গেছে বাড়ি। সামনে ওর বিয়ে। তার রুমমেট মারুফ ভাই গেছেন বরযাত্রায় যোগ দিতে। বাসায় আপাতত একা থাকছি বলে প্রতিদিনই শোয়ার আগে দরজা-জানলা ভালো করে চেক করে নেই। পোঁকা-মাকড় গলার সুযোগ থাকলেও আস্ত মানুষ ঢুকে পড়ার কোনো উপায় রাখি না আমি। আজো এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাহলে কিৃ!

ধড়মড় করে করে উঠে বসলাম। সামনেই মূর্তিটা দাঁড়িয়ে। নারী মূর্তি। এই অন্ধকারে নিজের হাত না দেখা গেলেও তার অবয়ব অনেকখানিই স্পষ্ট। গলাটা কখন যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পানির জন্য বুকের ছাতি ফেটে যেতে চাইছে। কিন্তু কথা বলার শক্তি যেমন খুইয়ে বসেছি, নড়ার শক্তিটাও পাচ্ছি না। বিছানার কাছেই ফ্লোরে পানির বোতলটা আমার অপেক্ষাতে আছে, জানি। মশারি থেকে হাতটা বের করলেই ছোঁয়া পাব তার। কিন্তুৃ!
‘সাব, কি ভয় পাইছেন?’ নারী মূর্তিটা একটু তাচ্ছিল্যের সাথে প্রশ্নটা করলো যেন!

‘হ্যা, আমি ভয় পেয়েছি। সেই সঙ্গে বিবাহিত আমার ঘরে এতো রাতে অন্য এক নারীর আনাগোনা, লোক জানলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আপনি যে-ই হোন না কেন, এক্ষনি বেরিয়ে যান।’ কথাগুলো বলতে ফুসফুস আর কণ্ঠের সঙ্গে রীতিমত যুদ্ধ করেও কিছু বলতে পারলাম না। টু শব্দটাও বের হচ্ছে না গলা দিয়ে। খুব সম্ভবত আমি স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু জেগে জেগে কীভাবে স্বপ্ন দেখে মানুষ। আমার কোনোদিনও হ্যালুসিনেশন হয়নি! নিজের হাতে চিমটি কাটতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু দেহের ভেতর প্রানের অস্তিত্ব ছাড়া আমি আর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছি না!

‘সাব, আমি পরী। ছুডুকালে খুব সুন্দর আছিলাম দেইহা বাপে এই নাম রাখছিল। পুরা নাম পরী বানু। আফনে ভয় পাইয়েন না সাব। আমি কিছু করমু না আফনেরে। কয়ডা কতা কইয়াই চইলা যামু।’

কিন্তু কীসের কি! পাথরের মতো স্থবির হয়ে যাওয়া আমার দেহটা কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না! বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে আমার কাছে কেন? কী বলতে চায় সে? জিজ্ঞেস করতে পারছি না। সবচেয়ে বড় যে ইচ্ছেটা ভর করেছে আমার ওপর, তাও করার সুযোগ নেই। ইচ্ছে হচ্ছে, এক ছুটে বাইরে গিয়ে চিৎকার করে দিন-দুনিয়া ফাটিয়ে ফেলি। আশেপাশের সব বাড়ির লোকজন জাগিয়ে তোলার ইচ্ছেটা প্রথম থেকেই প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে।

একটা সময় সে আসলেই মানুষ, না প্রেতাত্মা- নিশ্চিত হতে তার পা দেখতে ইচ্ছে হল আমার। খুব সম্ভবত উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে উঠছে মস্তিষ্ক। একে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘অভিযোজন’। অর্থাৎ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। যেমন- কোনো ভাইরাস যখন প্রতিকূল পরিবেশে পড়ে, তখন সে তার দেহের চারপাশে শক্ত আবরন তৈরি করে। এই দশায় জীববিজ্ঞানে ভাইরাসকে ডাকা হয় ‘স্পোর’ নামে। আমার মস্তিষ্কও খুব সম্ভবত চলমান পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করছে। আর তাই সে এখন তার মধ্যে জমা পড়া স্মৃতি থেকে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছে, আসলে কী ঘটছে।

ছোটবেলায় গল্পে শুনেছি, প্রেতাত্মাদের নাকি পা উল্টো থাকে। এবং তাদের কোনো ছায়া থাকে না। অশরীরির দেহই নেই, তাহলে আলোর চলার পথে বাঁধা তৈরি করে ছায়া ফেলবে কি দিয়ে? কিন্তু আমার ঘরে বর্তমানে কোনো আলো নেই। কাজেই ছায়া দেখারও উপায় নেই। সেই সঙ্গে তার পা-ও দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ পুরনো প্রশ্নটা আবার মাথাচাড়া দিল। অন্ধকারে আমি তাকে দেখছি কি করে?

‘সাব, বাঁইচা থাকাকালে আমি গার্মেন্টসে কাম করতাম। ছুডু স্বপ্ন আছিল আমার। খাইয়া-পইরা জীবনডা পার কইরা দিতে চাইছিলাম। কিন্তু হেইডা আর হইল না!’

এবার আমি খুব সম্ভবত মূর্ছা যাচ্ছি। বেঁচে থাকাকালে বলতে কী বোঝাতে চাইছে মেয়েটা? তার মানে কিৃ?

‘আমার বাড়ি আছিল কিশোরগঞ্জ। দুঃসম্পর্কের এক মামারে ধইরা সাভারের জিরানিতে একটা গার্মেন্টসে কাম নিছিলাম। পরতেক মাসে যা পাইতাম, মায়েরে পাঠাইতাম। ছুডু ভাইডা ইশকুলে পড়ে। হেরে আফনেগো মতোন সাব বানাইতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার স্বপ্ন স্বপ্নই রইয়া গেল!’
ডুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। কখন যে বিছানায় যে প্রান্তে আমি পা দিয়ে শুই, সেই প্রান্তের কাছে ফ্লোরে বসে পড়েছে সে, খেয়ালই করিনি। আমার খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। এক ফোঁটা জলের জন্য মরুচারী বেদুঈন কতোটা ছটফট করে, আজ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। সেই সঙ্গে পঙ্গু অথর্ব বাকশক্তিহীন মানুষগুলোর যন্ত্রণাও পুরোপুরি ছুঁয়ে যাচ্ছে। একটু নড়ার জন্য, একটু কথা বলার জন্য, গলায় একটু জল ঢালার জন্য আমার প্রান ছটফট করে মরে যাচ্ছে! কিন্তু মেয়েটার এদিকে কোনো খেয়ালই নেই। সে নিজের মতো কথা বলে চলেছে।

‘জুয়েল মিয়ারে কেমনে কেমনে জানি ভালো লাইগা গেল। হে আমাগো কারখানাতেই কাম করতো। কাম ফালাইয়া আমার দিকেই চাইয়া থাকতো খালি। শিফট শেষ কইরা যহন ঘরে ফিরতাম, আমার পিছন পিছন যাইতো। আমার একখান সখী আছিল। নাম আছিল মায়া। আমরা এক লগেই ছুডু একটা ঘর ভাড়া কইরা থাকতাম। এক বিছনায় পাশাপাশি শুইয়া আমরা যে কত রাইত গল্প করতে করতে পার কইরা দিছি, তার কুনু হিসাব নাই। মায়াই একদিন কইল, জুয়েলরে নিয়া ঘর বাঁধন যায়। আমারো তাই মনে হইছিল। হেরফর আমি আর জুয়েল দুইজনে মিলা স্বপ্ন দেহন শুরু করলাম।’

যখন নিজের জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া পড়ে যায়, তখন আশেপাশে কী ঘটছে কিংবা কে কী বলছে- তার কোনো খোঁজ রাখে না মানুষ। আমারো মেয়েটার দিকে কোনো খেয়াল নেই। কিন্তু কী করে যেন তার কথাগুলো আমার শ্রবণেন্দ্রিয় ভেদ করে মস্তিষ্কে গেঁথে যাচ্ছে! অশরীরিরা মনে হয় এভাবেই ভর করে মানুষের ঘাড়ে!

‘একদিন জুয়েল মিয়া আমারে বিয়ার কতা কইল। সরমে আমি হেইদিন তার দিকে তাকাইতেই পারতাছিলাম না। ওই দিনই মায়েরে মুবাইল কইরা হের কতা কইলাম। মায়ে পরথমে একটু গাঁইগুঁই করলেও পরে জুয়েলের ব্যাফারে সব হুইনা মত দিয়া দিল। জুয়েলের বাফে একদিন আমারে দেখতেও আইল আমগো বাড়ি। আমি তহন ছুডি নিয়া বাড়ি গেছি। হে পছন্দ কইরা পাকা কতা কইয়া গেল মায়ের লগে।’

মেয়েটা বলেই চলেছে। মানুষের যখন কথা বলার ঝোঁক চাপে, তখন সে আপন মনে বলেই চলে। শ্রোতা শুনছে কি শুনছে না, সেদিকে তার খেয়াল থাকে কম। কিন্তু পরী তো অশরীরি। সে কেন মানুষের মতো আচরন করছে? আমি সদ্য পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো হাসফাঁস করছি নিজেকে ফিরে পেতে।

‘হেরফর আমি আবার ঢাহা আইলাম। কাম শুরু করলাম। জুয়েল মিয়ারে কইলাম, বিয়ার ফর রোজ দেখবার পারবা আমারে। এহন একটু কম দেহ। এই রহম চলতে থাকলে কিন্তু চাকরি যাইবো। আমগো স্বপ্নও দিন দিন বড় হইতে থাকলো। বিয়ার তিন বছর পর বাচ্চা নিমু ঠিক করছিলাম। পোলাপানের নামও ঠিক কইরা ফালাইছিলাম। পোলা হইলে নাম রাখতাম সালমান, আর মাইয়া হইলে মাধুরী। সালমান আমার পছন্দের হিরু। আর জুয়েল তো পারলে আমারে ফালাইয়া মাধুরীরে বিয়া করে! চিনলেন না সাব। হেরা হিন্দি ছবির নায়ক-নায়িকা।’

পরীকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে, আমি চিনেছি ওদের। নামকরা এই নায়ক-নায়িকাকে চেনে না এমন লোক খুব কমই আছে। কিন্তু আমি তো এখন বাকশক্তিহীন পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষ। কিছুই বলতে পারছি না। কেন যেন আমার মনে হচ্ছে আমি মরে গেছি। ছোটবেলার গল্পে এও শুনেছি প্রেতাত্মা নাকি মানুষের ঘাড় মটকে মেরে ফেলে। পরী যেহেতু আমাকে মারেনি এখন পর্যন্ত, কাজেই খুব সম্ভবত আমি মরে গেছি। দুই প্রেতাত্মা এখন গল্প করছে। একজন শুনছে, অপরজন শুনছে। কিন্তু আমি মারা গেলাম কীভাবে? আমি তো দিব্যি রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে এক ফোঁটা ঘুমের জন্য ছটফট করছিলাম। মরে গেলাম কখন? আত্মা বের হওয়ার সময় নাকি প্রচ- কষ্ট হয়। আমি তাহলে কেন বুঝলাম না আমার দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে গেছে? আর যদি গিয়েই থাকে, তাহলে আমার প্রানহীন দেহটা এখন কোথায়?

‘যেই দিন মইরা গেলাম, হেই দিন সকালডা অন্য সকালগুলার মতো একই রকম আছিল। হেই দিনও সূর্য উঠতে দেখছি। আটটার সুময় ডিউটি আছিল। ভোরে জাইগা রাইন্দা আমি আর মায়া এক লগে খাইছি। খাইতে খাইতে সখী আমারে জুয়েলরে নিয়া ক্ষেপাইতাছিল। আমার ভালো লাগতাছিল, তয় সরমও পাইতাছিলাম। ধমক দিছিলাম একখান, এখনো মনে আছে।’

‘তারপর?’

আরে! আমি কথা বলতে পারছি! এই প্রথম আমার কণ্ঠ ভেদ করে ফুসফুস তাড়িত বায়ু অর্থবোধক শব্দ হয়ে বেরিয়ে এলো। তাহলে কি আমি মারা যাইনি? এ কি! আমার হাত নড়ছে। পা নাড়া দিতেই তাও নড়ে উঠলো। যে দেহটার অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিলাম না এতক্ষণ, তা এখন সাড়া দিচ্ছে! কিন্তু জলের তৃষ্ণাটা গেল কোথায়? একটু আগেও এক ফোঁটা জলের জন্য বুকের ছাতিটা ফেঁটে যাচ্ছিল। আর এখন? মনে হচ্ছে বুকের ভেতর অথৈ জল! আমার কোনো তৃষ্ণাই নেই!
‘হেরফর আমি, মায়া আর জুয়েল এক লগে ফ্যাক্টরিতে গেলাম। যাওনের সুময় জুয়েল আর মায়া মিলা কী যে করল? দুই জনে মিলা এমুন এমুন কতা কইতাছিল, আমি সরমে মইরা যাইতাছিলাম। লাঞ্চের কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ ফ্যাক্টরির নীচ তলায় হইচই শুরু হইল। হুনলাম আগুন লাগছে। আমার আত্মার পানি হুগাইয়া গেল এই খবরে। কয়দিন আগেও একটা ফ্যাক্টরিতে আগুন লাইগা বহুত মানুষ মরছে। আইজ আমগো এইহানে লাগলো। ভয়ে আমি কতা কইতে পারতাছিলাম না। হগ্গলে ছুডাছডি করতে লাগলো বাঁচনের লাইগা। আমি ক্যান জানি নড়তে পারতাছিলাম না। খুব পানি খাইতে মন চাইতাছিল। বুকটা কহন যে হুগাইয়া কাঠ হইয়া গেছে, টেরই পাই নাই। মায়া আমারে ধইরা টানতাছিল জানলার দিকে। নীচে নাকি গেট আটকাইয়া দিছে! বাইর হওনের রাস্তা একটাই। জানলা দিয়া লাফ দেওন। কয়জনে মিলা জানলার গ্রিলও ভাইঙ্গা ফালাইছে। কিন্তু আমরা তো পাঁতালার উপরে। লাফ দিলে তো মইরা যামু!’
পরীর কথা আমাকে আবেশিত করে ফেলেছে। এবার আমি স্বেচ্ছায় নীরব ভূমিকা পালন করছি। ভয়টা যেন কোথায় উধাও হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমারই মতো রক্ত-মাংসের কোনো মানুষের কথা শুনছি আমি। এই গভীর রাতে একটা মেয়ে আমার ঘ,র্ে লোকে জানলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে, পরিবারের কাছে খবর গেলে ত্যাজ্য হওয়ার ঝুঁকি আছে, নববিবাহিতা স্ত্রীর কাছে সারাজীবনের জন্য মাথানত হয়ে যাবে- কোনো কিছুই খেয়ালে নেই আমার। স্ত্রী এখন তার বাপের বাড়ি। শাশুড়ি বেশ কিছুদিন ধরে কোমরের ব্যাথায় ভুগছেন। তাকে শশ্রুষা করতেই সে সেখানে গেছে এবার। আপাতত সে জামালপুরে আমাদের বাসায় থাকলেও মাস ছয়েক পর তাকে ঢাকা এনে নিজের কাছে রাখার পরিকল্পনা করেছি। ওই সময় একটা ভালো মানের স্বল্প ভাড়ার ছোট ফ্ল্যাট নেব বলে ঠিক করে রেখেছি। কিন্তু পরীর গল্প শুনতে শুনতে এসবের সবকিছুই আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে।

‘তারপর কী হল?’ সম্মোহিতের মতো প্রশ্ন করলাম আমি।

‘একটা সুময় আগুনের ধোঁয়া উপরে উইঠা আইলো। চারদিক অন্ধকার হইয়া গেল যেন। মায়া বেশ কিছুক্ষণ আমারে টানাটানি কইরা নড়াইতে না পাইরা জানলা দিয়া ততক্ষনে লাফ দিছে। বাঁইচা আছে, না মইরা গেছে- জানি না। জুয়েলেরও কুনু খোঁজ জানি না। আমার দম বন্ধ হইয়া আইল। শেষ সুময়ে বাঁইচা থাহনের ইচ্ছাডা আমারে চাইপা ধরলো। কুনুদিক না তাকাইয়া দৌড় দিলাম। আমাওে বাঁতে হইবো। ছুডু ভাইডাওে আফনেগো মতোন সাব বানাইতে হইবো। মায়েরে বিয়ার ফর আমার কাছে আইনা রাহনের চিন্তা করছিলাম। আমি মইরা গেলে জুয়েল অনেক কষ্ট পাইবো। কত যে চিন্তা মাথায় ঘুরতাছিল, হিসাব নাই! জানলার দিকে ছুটলাম। কি যেন পায়ের সঙ্গে বাঁইধা গেল! পইড়া গেলাম আমি। মাথাডা বাড়ি খাইলো শক্ত কিছুর সঙ্গে। জ্ঞান থাকলেও আবার উইঠা দাঁড়ানর শক্তি ছিল না শরীরে। একটুখানি নিঃশ্বাস নেওনের জন্য বুকের ভেতরডা ফাইডা যাইতাছিল। আগে কহনো বুঝি নাই, নিঃশ্বাস এতো দামি জিনিস!’
আবারো কেঁদে উঠলো পরী। আমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কারোর স্বজন মরে গেলে একটা কিছু সান্ত¦না দেওয়া যায়, কিন্তু যে নিজেই মরে গেছে, তাকে কী বলে সান্তনা দেব? পরী আমার সান্ত¦না বাক্যের অপেক্ষায়তেও নেই। নিজের মতো এখনো বলে চলেছে সে।

‘দমের জন্যে হাসফাঁস করতে করতে একটা সময় শরীওে আগুনের তাপ লাগল। আবছা আলোয় দেখলাম আমার ওড়নায় আগুন! আমগো ফ্লোরে তহন আগুন চইলা আইছে। মনে মনে আল্লারে ডাকলাম। নিয়ত করলাম, বাঁইচা গেলে এক মাস নফল রোজা রাখমু। জীবনে আর নামাজ কাযা করমু না। শাহজালালের দরগায় মানত চড়ামু। তাও আমি বাঁচবার চাই! হঠাৎ নাক-মুখ বুইজা আইল আমার। জিহ্বায় লবণের মতো স্বাদ লাগলো। হেরফর আর কিছু জানি না সাব!’
কি মর্মান্তিক মৃত্যু! কী দিয়ে এই মৃত্যুর ব্যাখ্যা করা যায়? কী দিয়ে আগুনে ছাঁই হয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোর মূল্য পরিশোধ করা যায়? আমি কিছু জানি না! হঠাৎ চিচিচি-চিচিচি-চিচিচি শব্দে কি যেন বাজতে শুরু করলো ছন্দ করে। পরী কি এমন শব্দ করছে? আবার আমার মনে প্রেতাত্মার ভয় ভর করল। আবার মনে হল, আমি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হচ্ছি!

ধড়মড় করে উঠে বসলাম। কখন যে ঘুমের জন্য ছটফট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বুঝতেই পারিনি। মোবাইল ফোনের অ্যালার্মটা চিচিচি-চিচিচি-চিচিচি শব্দে বেজে চলেছে একনাগাড়ে। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছি। শোয়ার বালিশ, বিছানা সব ঘামে ভিজে চুপচুপ করছে। হাতড়ে সুইচ খুঁজে আলো জ্বালালাম ঘরে। নেই, কেউ নেই এখানে! একা একাই কথা বলে নিজের বাকশক্তি পরীক্ষা করলাম। শরীর নড়ছে, কথা বলতে পারছি, দেখতেও পাচ্ছি সব। বুকের ভেতর যেন প্রান ফিরে এলো। পরী আসলে কোনো অশরীরি না তাহলে। এতোক্ষণ যা ঘটতে দেখেছি, তার পুরোটাই স্বপ্ন! বাইরেও ব্যস্ততার জানান দিয়ে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। অফিসের জন্য তৈরি হতে হবে। বিছানার কাছে ফ্লোরে থাকা বোতলটার অর্ধেক জল ঢকঢক করে সাবাড় করে দিলাম। বেসিনে গিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিলাম।

বছরখানেক আগে সাভারের জিরানিতে একটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছিল। পুড়ে মারা গেছে বেশ কয়েকজন কর্মী। ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া জুয়েল নামের এক যুবকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল আমার এক সাংবাদিক বন্ধু। তার কাছে এবং পরবর্তীতে পত্রিকায় জুয়েলের সাক্ষাৎকারটা পড়েছিলাম। জানালা থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রানে বেঁচে গিয়েছিল জুয়েল। কিন্তু পা দু’টো আর বাঁচেনি। সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে সে। স্বপ্নে পরীর মুখে যা শুনেছি, তার প্রায় সবই আমার পড়া। বাকি ছিল শুধু প্রান হারানর মুহূর্তের ঘটনাটা জানা। বছরখানেক আগে শোনা সেই ঘটনাটা হয়তো সাবকনসাস মাইন্ডে রয়ে গিয়েছিল আমার। সেটাই স্বপ্নে দেখেছি। মানুষ তো আসলে স্বপ্নে যা দেখে, তা হয় তার কনসাস, সাব-কনসাস মাইন্ডে জমে থাকা স্মৃুতি, নতুবা ভবিষ্যৎ ঘিরে তার ভাবনা। তবু প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে একটা। জুয়েরের সাক্ষাৎকারে পরীর মৃত্যুর সময়ের ঘটনা আমি পড়িনি। তাহলে স্বপ্নে এসব বলল কি করে? তবে কি সত্যিই সে এসেছিল আমার কাছে?

তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, আর কত প্রান ঝরে গেলে এভাবে বদ্ধ অবস্থায় দগ্ধ হওয়া বন্ধ হবে?

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.