খ্যাতিমান গীতিকার এস.এম খুরশিদ

0

আবছার উদ্দিন অলি : এস.এম খুরশিদ এক অনন্য সাধারন ব্যক্তি। যিনি তার নিরন্তর প্রচেষ্টায় আর কর্মে আমাদের আজকের প্রজন্মের জন্য পথ চলার জায়গাটি তৈরী করে দিয়েছেন। সেই তিনি এক নিভৃতচারী সুরের সাধক। যিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন সমৃদ্ধ সংস্কৃতির লালন, বিকাশ ও পরিশুদ্ধ এক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে আগামী প্রজন্মকে সাথে নিয়ে নিরন্তর নিরবে কাজ করে গেছেন। এস.এম খুরশিদ আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে করেছেন আলোকিত বর্ণাঢ্য ও সমৃদ্ধ। প্রচার-প্রাচুর্য্যে-স্বীকৃতির মোহমুক্ত এক নীরব কর্মী সংকল্পের দৃঢ়তায় পথের মাঝে পথের সন্ধান করে বেড়িয়েছেন। এস.এম খুরশিদ ছিলেন নিভৃতচারী প্রচার বিমুখ অন্তরালে থাকা এক সুন্দর মনের মানুষ। যার লেখনি ও শব্দচারণ গীতিকাব্য অনন্য অসাধারণ।

বিশিষ্ট গীতিকার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশ গীতিকবি সংসদ চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি এস.এম খুরশিদ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ২০১৬ সালের ৬ অক্টোবর বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি …. রাজিউন)। তিনি কখনও ফিরে আসবেন না আমাদের মাঝে। তবে তার গীতিকাব্যের অনবদ্য অবদান যুগে যুগে অমর হয়ে থাকবে। তার লেখনি আমাদেরকে মনে করিয়ে দেবে তিনি কতটা আপন ছিলেন। বিশ্বাস, ভালবাসা, সম্মান এই তিনের মাঝে তিনি ছিলেন এক আদর্শবান সৎ মানুষ। সততা, নিষ্ঠা দিয়ে কাজ করেছেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। অন্যায় আর রক্তচক্ষুকে কখনো ভয় করেননি। আপোষ করেননি কোন লোভ-লালসার কাছে। নানা প্রলোভনে নিজেকে বিসর্জন দেননি। সত্যকে সত্য বলার সাহস তার মাঝে ছিল, সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলতেন।

এস.এম খুরশিদ ছিলেন গীতিকাব্যের বটবৃক্ষ। বাংলাদেশ বেতারে ১৯৭৪ এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৮৮ সালে গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন এবং বিশেষ শ্রেণির গীতিকার হিসেবে তিনি বিশেষ বিশেষ দিবসে গান রচনা করে সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহন আমাদের করেছে গর্বিত। দেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করে দেশের স্বাধীনতা এনেছেন। বিনিময়ে দেশ পেয়েছে লালসবুজের পতাকা, পেয়েছি বিজয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা বীর বাঙালির অহংকার এই শ্লোগানের রূপকার তিনি। তিনিই প্রথম বিজয় মেলার কনসেপ্ট তৈরি করেন। বেতার টেলিভিশনে তার গান দর্শক শ্রোতাদের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিল অত্যন্ত সাবলীল ভাবে। ১৯৪৮ থেকে ২০১৬ দীর্ঘ সময়ে এস.এম খুরশিদের বর্ণাঢ্য জীবন আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি নবীন গীতিকারদের উৎসাহ যোগাতেন। শিখিয়ে দিতেন হাতে কলমে। অহংকার আর আমিত্ব তার মাঝে ছিল না। তিনি ছিলেন গীতিকারদের যোগ্য অভিভাবক। সভাপতির পদে থাকাকালীন তিনি দক্ষ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। বেতারে প্রতিটি বিষয় ভিত্তিক গীতি নকশা রচনা করেছেন।

এস.এম খুরশিদের সব বিষয়ে পারদর্শীতা আমাদের নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি বড় মাপের একজন গীতিকার ছিলেন। সেই সাথে সুন্দর ও ন্যায়পরায়ন মানুষ ছিলেন। কাউকে ঠকানোর বা কারো ক্ষতি করা তার মধ্যে ছিল না। ছিল মানুষের উপকার আর সহযোগিতা করা। তার সহধর্মিনী অধ্যাপিকা ডা: খোদেজা খুরশিদ অপরাজিতা বেতার টিভি’র তালিকাভুক্ত প্রথম শ্রেণির গীতিকার। ছেলে ইকবাল ভূঁইয়া একজন বিনোদন সাংবাদিক ও ক্রীড়া কলাম লেখক। তার তিন কন্যার মধ্যে ফরিদা ইয়াসমিন শিলু একজন চিত্রাংকন শিল্পী। অন্য দু’জন রেহানা ইয়াছমিন ও শাহীনা ইয়াছমিন বাপ্পী মডেলিং এর সাথে যুক্ত ছিলেন।

১৯৪৮ সালের ১লা জানুয়ারী চট্টগ্রাম জেলার মিরশ্বরাই নানার মহালংকা গ্রামে এস.এম খুরশিদ জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মৃত এস.এম আমিনুল হক ভূঁইয়া, মাতা মৃত ছমনা খাতুন। মিরশ্বরাই জন্ম নেয়া এস.এম খুরশিদের বাঙালি জাতির অহংকার, আমাদের গৌরব। তিনি এদেশের সূর্য সন্তান। মুক্তিযোদ্ধাকালীন তার লেখা মাগো মা আমার মা লাল জামাটা পড়িয়ে দে মা, লাল ঘোড়াটা সাজিয়ে দে এই গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বহুবার প্রচারিত হয়। যুদ্ধকালীন সময়ে পুরো জাতিকে উজ্জীবিত করেছে এই গান। এস.এম খুরশিদ আমাদের সাহসী ঠিকানা, মানুষকে আপন করে কাছে টেনে নেয়া, আদর, আপ্যায়ন আর আতিথেয়তায় তিনি ছিলেন সবার আগে। সেই আড্ডা দেওয়া শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি মুক্তিযুদ্ধ গীত রচনা প্রতিবাদী আলাপ চারিতায় তিনি বেশ প্রাণবন্ত ছিলেন।

চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এই প্রিয় মানুষটি তার মহৎকর্মের জন্য যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। আমরা তার অসমাপ্ত কাজগুলো এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে সম্মিলিত ভাবে কাজ করে যেতে হবে। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ তার যে পান্ডুলিপি সেটি পুস্তক আকারে দেশব্যাপী প্রকাশনার কাজটি করতে পারলে তখনই হবে তার স্বার্থকথা। জীবিত থাকতে যে সম্মানটুকু প্রাপ্য ছিল, তা তিনি পাননি। মৃত্যুর পর হলেও চেষ্টা থাকবে তাকে তার যোগ্য সম্মানে সম্মানিত করা। এটিই এখন সময়ের দাবী।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.