কে তুমি? কে তুমি?

0

টোকন ঠাকুর

জমির মালিক যদি জমিদার হন, মেঘের মালিক কে? মেঘাদার? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পারিবারিক পরম্পরায় জমিদার ছিলেন, আমরা জানি। শিলাইদহ-পতিসর-শাহজাদপুরে এসেছেন বারবার, জমিদারি দেখভাল করতে। কারণ তিনি জমিদার। জমির মালিক।

পারিবারিকভাবে জমিদার হলেও মেঘের মালিক তিনি মেঘাদার ছিলেন সম্পূর্ণ নিজের ভাবনায়, নিজের রচনায়। তাই ‘কালিদাস তো নামেই আছেন’– আমরা দেখলাম, বর্ষা শ্রীমতী হলো রবীন্দ্রনাথের হাতে। যেন বা এমন, বাংলার বর্ষার যত মেঘ, সব রবীন্দ্রনাথের। কারণ, তিনি মেঘাদার। আমরা প্রজা-পাঠকেরা শুধু ভিজতেই থাকব। ভিজতে ভিজতে আমরা কেউ কেউ ‘বিদ্রোহ’ করেছি, আমরাও দু’এক কাঠা মেঘের মালিকানা চেয়েছি। চেয়ে, আমরাও পাঠক-প্রজাকে ভেজাতে চেয়ে ‘মেঘ’, ‘মেঘ’ বলে কলম ধরেছি। কিছু বৃষ্টি রচনা করতে চেয়েছি। কিছু মন্দ্রস্বর আমরাও গলায় ভাজতে চেয়েছি।

তাই মেঘ আর আজ পুরোটাই রবীন্দ্রনাথের দখলে নেই, দু’একটি বিচ্ছিন্ন মেঘ আমাদেরও দখলে চলে আসছে। তাই নিয়ে দু’চার ছত্র পদ্য-কবিতাও লিখছি আমরা। হয়তো আবছায়া দিন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে পর্দাজুড়ে। দূরে, ঝাপসা হয়ে যাওয়া গ্রাম। বৃষ্টিতে থই থই করা স্কুল মাঠ, আর্দ্রপ্রাণ বাল্যবেলা সব একাকার হয়ে প্লাবন প্লাবন লাগে। আমি প্লাবনের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে যাই। দেখতে পাই, মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ভিজছে একটি গরু। ঘরের রেলিংয়ে, কার্ণিশে ফোটা ফোটা জল। একটি শালিক এসে চুপচাপ বসে আছে। এই শালিকটা খুব ভিজে গেছে সকাল থেকে। এই শালিকটা কি তরুণ কবি? ব্যথিত তার ডানা? এই ভেজা শালিককে আমি কোনো প্রশ্নই করব না। তবু শালিক সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করে, ‘ও শালিক তুই ভিজলি কেন, ঠান্ডা লাগছে না?

এরকম কোনো বর্ষাকালেই, সেকালের পাঠক পড়ছে কেউ, হয়তো কেউ পড়ছে না। তবু আমরা মনে মনে ভাববার সুযোগ নিচ্ছি- কিছু বৃষ্টি বুনেছি আমরা। কিছু ঝিরিঝিরি ছড়াই আমরা। কিছু রিমঝিম পড়াই আমরা। অবশ্য রিমঝিম বলতেই তো সেই টিনের চালে বৃষ্টি, বহুকাল টিনের ঘরে থাকি না আমরা। বিল্ডিংয়ে থাকি। বর্ষায় বৃষ্টির ছাট এসে লাগে জানালায়। জানলার ধারে বসে সেই ছাট লাগা বৃষ্টির শিহরণগুচ্ছ নিয়ে হয়তো একটি কবিতা লিখতে বসি। বর্ষার কবিতা। মেঘলাগা কবিতা। ফলে, কবিতা লেখা শেষ করতেই দেখি, পুরো খাতাই ভিজে জবজবে। বৃষ্টির কবিতা লিখে খাতা ভিজিয়ে ফেলা দিন আমরা পার করে করে যাই। টের পাই, সেই আদিগন্ত দুপুরে মেঘ কালো করে মামাবাড়িতে এক শালিকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল ছেলেবেলায়। সেই শালিকটা কবিতা লিখত। সেই কবিতা কোনো কাগজে ছাপা হয়নি কখনো, শালিকের লেখা বর্ষাভেজা কবিতাগুলো তারপরও আমি পড়েছি। পড়েছি? কোথায় পেলাম কবিতাগুলো?

কবিতাগুলো ছিল আষাঢ়ের মেঘে, শ্রাবণধারায়। কবিতাগুলো ছিল ধানের শীষে, ঘাসের ডগায়। কবিতাগুলো ছিল বৃষ্টিতে ভেজা নারকেল পাতার শরশর শব্দের ভেতর। কবিতাগুলো ছাপা হওয়ার পর বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোও ভেজা। ফলে, হেমন্তেও যখন সেই কবিতা পড়া হবে, পাঠক ভিজবে, পাঠিকা ভিজবে। হিম হাওয়ার ছোঁয়াচ লাগবে মনে। বর্ষার ক্ষমতা এমন! বর্ষা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে মেঘমল্লার রোডে। উল্লেখ্য, মেঘমল্লার রোডেই আমার পৈত্রিক বাড়ি। বাড়ি থেকে বেরুলেই গা ভিজে যায়। আমি মেঘের নিচে হাঁটি।

বাংলা কবিতা আর বর্ষা একাকার। বাংলা গান আর বর্ষার বিরহ একাকার। বাংলার বর্ষা তাই শুধু একটি ঋতুর বাইরেও আরেকটু কিছু।

‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ তোমাকে দেব। তুমি কোথায়, এই বরষায়? এই বৃষ্টিভেজা দিনে তুমি কোথায়? এই প্লাবন প্লাবন দিনে তুমি কোথায় এখন? এই যে লিখছি ‘তুমি’- তুমিটা কে? কে তুমি? তুমি কে? তুমিই বলে দাও না, কে তুমি? কেন আমি তোমাকেই খুঁজতে খুঁজতে, বহুদূরে এই মাঠের মধ্যে রাস্তা দিয়ে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি? কবি বলেছেন, ‘এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া।’ আবার সেই তুমি’র প্রসঙ্গ এলো। কে তুমি?

আষাঢ়ের মেঘ, কে তুমি?
ঝুপঝাপ বৃষ্টি, কে তুমি?
শ্রাবণের ঢল, কে তুমি?

তুমিই বলে দাও, কে তুমি? কেন তোমার নাকছাবিটা চিকচিক করছে?

১৫.৬.২০১৫

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.