নাগমাগুল ও রঙিন রত্নের ফেরিওয়ালা

0

সিটিনিউজবিডি  : মেহমুনখানার চিলেকোঠায় আছে নাদির শাহের তখতের মতো জবরজং একখানা কুরছি। তাতে আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাক ডুগাডুগ তাক ডুগাডুগ শব্দে ধড়মড় করে জেগে উঠি। নিচের সড়ক ধরে বুলন্দ আওয়াজে ডুগডুগি বাজিয়ে এক ফেরিওয়ালা হাঁক দিচ্ছে,‘ইমরোজ ঈদ আস্ত/ জিলাবি গর্ম আস্ত/ চয় তাঁজা আস্ত।’ এ দারী লবজের তরজমা করা যেতে পারে এ রকম, ‘আজ ঈদ/ ফ্রেশ চায়ের সঙ্গে গর্মাগ্রম জিলাবিও আছে।’ ছাদের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, আমার গাড়িচালক মেহরাব নুরানি জিলাবির সঙ্গে এক পেয়ালা সবুজ চা কিনছে। ঈদের দিন বলে নুরানি খুব বাওছাও করে পাগড়ি বেঁধেছে। তার কোমরবন্ধে গোঁজা রিভলবার। বেলা তেমন হয়নি, তবে নুরানি যখন এসে পড়েছে, বেরিয়ে পড়তে হবে এখনই।
জানালার কাচে খুব তোড়জোড়ে ঝোড়ো হওয়া আছড়ে পড়ছিল, তাই জেগে উঠি ঠিক সুবহে সাদিকের সময়। কামরা থেকে বেরিয়ে ছাদে আসতে গিয়ে বুঝতে পারি, ঝড়-তুফান কিছু নয়, প্রান্তর তোলপাড় করে হিন্দুকুশ পর্বতের দিকে উড়ে যাচ্ছে পরপর চারখানা জলপাই রঙের আপাচি অ্যাটাক হেলিকপ্টার। পাহাড়ের চূড়ায় লেগে থাকা যৎসামান্য তুষার কেবল মাখছে সুরুজের অরুণিমা। প্রান্তরে পিরামিডের মতো মাজেস্টিক কেতায় দাঁড়িয়ে আছে ছোট-বড় বেশ কয়েকখানা বৃক্ষহীন পাহাড়। ঈশানকোণে বিগত জামানার লাভাস্রোতের প্রবল এক প্রপাত যেন জাদুবলে রূপান্তরিত হয়েছে পাষাণে। আর তার ছায়ায় রুপালি লাবণ্য ছড়িয়ে ছুটছে গরবন্ড নদ। দুই পাশে দ্রাক্ষাকুঞ্জের সবুজ পত্রালিও যেন জলধারার সমান্তরালে হয়েছে চলমান। হেলিকপ্টারের ডানার তাড়নে আঙুরলতায় খেলে যাচ্ছে তুফানি হিল্লোল।
ছাদের চিলেকোঠায় ঢুকে বসে পড়ি নাদিরি কেতার কুরছিতে। আলামত খারাপ। আফগানিস্তানের কাপিসা প্রদেশে লড়াই-বিড়াই লেগে আছে হামেশা। প্রদেশের রাজধানী শহর মাহমুদ-ই-রাকি। শোনা যাচ্ছে ঈদের দিন কিছু একটা ঘটবে, তাতে টান টান হয়ে আছে স্নায়ু। ভাবি, কিসমতে নির্ধারিত আয়ুর ওপর ভরসা করে কাটিয়ে দিতে হয় আজকের দিন। মাহমুদ-ই-রাকিতে থেকে যাওয়া কি সমীচীন হলো? চাইলে ফিরে যেতে পারতাম কাবুলের অপেক্ষাকৃত নিরাপত্তায়। কিন্তু ওস্তাদ রাহিয়াব কিজিলবাসের কাছ থেকে পাওয়া একখানা দাওয়াতনামা এখানে ঈদ কাটাতে উৎসাহিত করল। ২০০৩ সালে আমি যখন কাবুলের ‘পাহানতুনে তালিমে তারবিয়াত’ নামের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলাম, তখন সায়েন্সের প্রফেসর ওস্তাদ কিজিলবাসের সঙ্গে দোস্তি হয়। ওস্তাদ হালফিল রিটায়ার করে মাহমুদ-ই-রাকি শহরের প্রান্তিকে দৌলতে-খেয়াল নামের গ্রামে বসবাস করছেন। আমি এদিককার আলবিরুনি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে আসলে তাঁর কাছ থেকে দাওয়াতনামাটি পাই। তিনি পত্রজনিত ত্রুটির জন্য মার্জনা চেয়ে ধ্রুপদি ফারসিতে যা লিখেছেন, তার তরজমা হবে, ‘ঈদের দিন গরিবালয়ে মেহেরবানি করে পদার্পণ করত দোয়াদানে সরফরাজ করতে মর্জি হউক।’ এ ধরনের দাওয়াতপত্রকে অবজ্ঞা করা বেমনাসিব মনে হয়। তাই আজ কিজিলবাসের পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করতে যাচ্ছি।
ঈদের দিন মাঠে খাটানো নাগরদোলায় ঘূর্ণিপাকে দুলছে বালিকারাঈদের দিন বলে সড়ক ফাঁকা। মিনিট পনেরোর ড্রাইভে এসে পৌঁছি দৌলতে-খেয়াল গ্রামে। গল্লির বাইরে টিলার মতো একটি ঢিবি। ফরাসি আর্কিওলজিস্টরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানাচ্ছেন যে এর তলায় মৌর্য সাম্রাজ্যের আমলের কিছু ভগ্ন ঘরদুয়ার লুকিয়ে আছে। তাই গাড়ি দাঁড় করিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, হয়তো এ বিরান ভূখণ্ডের কোনো ইমারতে বসে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য গ্রিক রাজা অলিকসুন্দরের সেনাপতি সেলুকাসের কাছে যুদ্ধসন্ধির জন্য চিঠিচাপাটি পাঠিয়েছিলেন। ঈদের অজুহাতে এ মহল্লার ঘরদুয়ার-দোকানপাটে রঙিন কাগজের সাজি ও মালা ঝুলিয়ে সাজানো হয়েছে। ফুটপাতে জোট বেঁধে বসে পাঁচ-ছয়টি বাচ্চা ছেলে খরিদ করছে লাল রঙে রাঙানো সেদ্ধ ডিম। এগুলো ছোড়াছুড়ি করে তারা লিপ্ত হবে ‘তোখম-জঙ্গি’ বা আন্ডা-যুদ্ধে। আমরা এসে পড়ি একটি চুড়ির দোকানের সামনে। নীল বোরকা পরা দুই নারী দামদর করে কিনছেন বেলওয়ারি চুড়ি। ঈদের দিন পরিবারের কম বয়স্কদের গিফট জাতীয় কিছু কিনে দেওয়ার রেওয়াজ আছে। আফগান সংস্কৃতিতে তা ‘ঈদি’ বলে পরিচিত। ভাবি, ওস্তাদ কিজিলবাসের কন্যা নাগমাগুলের জন্য কি ঈদি হিসেবে কিনে নেব এক গোছা কাচের চুড়ি? নাগমাগুলের সঙ্গে আমার কখনো সাক্ষাৎ না হলেও তার সম্পর্কে ওস্তাদের কাছে এত শুনেছি যে এ তরুণীকে পরিচিত মনে হয়। আন্দাজ করি, তার বয়স আমার চেয়ে বছর পনেরো কম হবে। সুতরাং স্নেহভাজন হিসেবে তাকে ঈদি দেওয়ার হক আমার আছে। কিন্তু চুড়ি উপহার দিলে যদি ভুল-বোঝাবুঝি হয়?
না, চুড়ি আমি কিনি না। তবে হেঁটে যেতে যেতে তার কথা ভাবি। ওস্তাদের কাছে শুনেছি যে একসময় সে ডিপ্রেশনে ভুগত। ঘুমাতে পারত না রাতের পর রাত। ঘরে বসে একা তার সময় কাটত না। এ সময় কিছু বইপত্র জোগাড় করে ইংরেজি শিখতে শুরু করে সে। কাবুলে ইংরেজি বইপত্র জোগাড় করা খুব ঝকমারি ছিল। তাই আমি তাকে শিশুপাঠ্য কিছু বইপত্র জোগাড় করে দিই। একটি ক্লাসে একবার বেগম রোকেয়ার ওপর সেমিনার দিয়েছিলাম। তখন রোকেয়ার জীবন নিয়ে ইংরেজিতে একটি পাম্ফলেট করেছিলাম। তো, ওস্তাদ সেই পাম্ফলেটের একটি কপি নাগমাগুলকে দিলে তা পাঠ করে শোকরগুজার করে সাদাসিধে ইংরেজিতে আমাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল সে। ওস্তাদ কিজিলবাসের সঙ্গে আমার একটা বিষয়ে মিল ছিল। আমরা দুজনে পড়ানোর ফাঁকে ফেকাল্টি লাউঞ্জের নিরিবিলিতে বসে রোজনামচা লিখতাম। মাঝেমধ্যে ওস্তাদ পুরোনো ডায়েরির পাতা থেকে পড়ে শোনাতেন। তখন জানতে পারি তালেবানি আমলে তাঁর কারাবাসের কথা। ক্লাসে বিজ্ঞান পড়াতে পড়াতে তিনি নাকি মন্তব্য করেছিলেন, ইনসানের পক্ষে চাঁদে অবতরণ করা সম্ভব। কথাটি তালেবদের কানে গেলে তাঁকে পাঠানো হয় পুলেচরকির জিন্দানখানায়।
নাগমাগুল একটি শিশুস্কুলে শিক্ষয়িত্রী হিসেবে কেবল কেরিয়ার শুরু করেছে। তালেবি ফতোয়ায় মেয়েদের পড়াশোনা সাফ হারাম—এ এলান দেওয়া হলে সে তার মায়ের সঙ্গে কাবুল ছেড়ে চলে যায় মাহমুদ-ই-রাকি শহরের দৌলতে-খেয়াল গ্রামে। বাপের মতো তার ধমনিতেও বোধ করি পড়ানোর নেশা আছে। গ্রামে সদ্য স্কুল থেকে বিতাড়িত কিছু মেয়েদের নিয়ে নিজের বাড়িতে গোপনে পড়াতে শুরু করে সে। বিষয়টি জানাজানি হলে তালেবরা তাকে গ্রেপ্তার করে মসজিদের সামনে বিচার বসায়। তাতে তার শরীরে ২৫ ঘা দোররা মেরে কারাবাসের রায় হয়। কিন্তু বিচারকদের মধ্যে এক মোল্লাকে সে নিকাহ করে শরিয়ত মোতাবেক জীবন যাপন করতে ওয়াদাবদ্ধ হলে তার সাজা মওকুফ করে খালাস দেওয়া হয়। তার বিবাহিত জীবন সম্পর্কে ওস্তাদ কখনো কিছু বলেননি। তবে লড়াইয়ে তালেবানদের পতন হলে আহমদ শাহ মাসুদের ফৌজদের হাতে তার স্বামী যুদ্ধবন্দী হয়। তাকে শহরের চকে ট্রাফিক পুলিশের ছত্রীতে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়।

ওস্তাদ কিজিলবাসকে বাড়িতে পাওয়া যায় না। তবে আধবোবা একটি ভৃত্য আমাদের ডেকে নিয়ে আঙিনায় বসায়। নাশপাতিগাছের ছায়ায় তক্তপোশের ওপর গালিচা পেতে তাতে সবুজ চায়ের সরঞ্জাম রাখা। সরপোশে ঢাকা ‘সরনাখোদ’ বলে আফগানি বুটের হালুয়া, তাতে বাদাম দিয়ে নকশা করে লেখা ‘ঈদ মোবারক’। সঙ্গে টুকরো টুকরো নান, কিশমিশ ও আখরোট। ওস্তাদের স্ত্রী চৌকাঠের আড়াল থেকে অনুযোগ করে বলেন, জনাবে কিজিলবাস আর আগের হালতে নেই, বয়স বাড়াতে তিনি কেমন জানি খামখেয়ালি কিসিমের হয়ে গেছেন। আমার ইন্তেজারিতে সবকিছুর আয়োজন করে একটু আগে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। গ্রামে বিমার আজারে কষ্ট পাচ্ছেন দু-তিনজন মানুষ, ওস্তাদ কাগজে তকবির লিখে গঁদ দিয়ে তাদের চৌকাঠে আটকে দিতে গেছেন। তো, আমি চা খেতে খেতে নাগমাগুলকে ঈদি দিতে পারি কি না, তার জন্য ইজাজত প্রার্থনা করি। বৃদ্ধা সানন্দে রাজি হন। ঠিক বুঝতে পারি না তার সঙ্গে চাক্ষুষ দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না?

আধবোবা ছেলেটি দরজার সামনে আঙুরের ঝাড়ে একটি সিল্কের চাদরি ঝুলিয়ে দেয়। নাগমাগুল বেরিয়ে এসে আমাকে তসলিমাৎ জানিয়ে তার আড়ালে দাঁড়ায়। ইংরেজি বলে সে স্বাচ্ছন্দ্যে; এবং তার কথাবার্তায় ছড়ায় ব্যক্তিত্ব। আমি আঙুরকুঞ্জের তলায় ছায়াতে তার দেহের পরিষ্কার প্রোফাইল দেখতে পাই। ঈদি হিসেবে ইন্টারনেট থেকে প্রিন্ট আউট নেওয়া বেগম রোকেয়ার সুলতানাস ড্রিম-এর কয়েকটি পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে আমি ঝুলন্ত চাদরির কাছে যেতেই আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে ত্বকে ফিকে সোনালি আভা ছড়ানো চুড়ি পরা একটি হাত। পৃষ্ঠাগুলোর ফোল্ডার তুলে নিতে নিতে সে মৃদুস্বরে বলে, ‘আই সিনসিয়ারলি একসেপ্ট ইয়োর ঈদি।’ মন্তব্যটি ফরমাল হলেও হাওয়ায় ভেসে আসা আতরের গন্ধের মতো তাতে আন্তরিকতার ছোঁয়া লাগে।
তখনই হইহুল্লোড় করে বাড়ি ফেরেন ওস্তাদ। তাঁর সঙ্গে আমাকে ঈদগাহে নিয়ে যেতে এসেছেন কওমের সরদার মীর মোর্তজা পোপালজাই। তাঁর মাথায় বাঁধা মোড়াছা যেন গোখরা সাপের মতো ফণা তুলে আছে। সরদারের কাঁধে ঝুলছে দোনলা বন্ধুক, কোমরবন্ধে গাঁথা একসারি টোটা। বিদেশি মেহমানকে ইজ্জত করে ঈদগাহে নিয়ে যেতে ঝালর ঝোলানো একটি ঘোড়ার গাড়িও নিয়ে এসেছেন তিনি। পুশতু ভাষায় ‘ঈদে করচানি আখতার’ বলে বারবার তিনি আমার কবজি এয়স্যা জোরে মুচড়ে দেন যে মচকানোর আশঙ্কায় সিঁটিয়ে থাকি আমি।

আমি আঙুরকুঞ্জের তলায় ছায়াতে তার দেহের পরিষ্কার প্রোফাইল দেখতে পাই

ঈদগাহে ওস্তাদ আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন ইমামের সঙ্গে। মাথায় জবরদস্ত মোড়াছা বাঁধা এ আলেমের সঙ্গে ইরানে ছাপা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার চিত্রিত চেহারার প্রভূত মিল আছে। আমি তাঁকে বলি, ‘খোশহাল শোদাম আজ মোলাকাতে সোমা’ বা ‘হুজুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াতে কী যে খুশি হয়েছি।’ তিনি ‘ঈদেত মোবারক রোজা ওয়া নামাজাত কবুল’ বলে আমার রোজা ও নামাজ যেন মঞ্জুর হয়, তার জন্য মোখতছরভাবে মোনাজাত করেন। সরদার পোপালজাই আসমানে নিশানা করে গুলি ছোড়ার মিনিট দশেক পর শুরু হয় নামাজ। খুতবার পরপর আরম্ভ হয় কোলাকুলির পালা। আলিঙ্গন করনেওয়ালাদের দেহে রীতিমতো মল্লযোদ্ধাদের বিক্রম। বাঙালি হিসেবে আমি তেমন পরাক্রমের পরিচয় দিতে পারি না বলে পরাস্ত বোধ করি। কালপুশ টুপি-পরা জনা কয়েক জোয়ান ‘ঈদে-খুশ ঈদে-খুশ’ বলে আমাকে পাকড়ে ধরে বেহুঁশ করে দেওয়ার উপক্রম করে।
দৌলতে-খেয়ালে ফেরার পথে কোচওয়ান ওস্তাদকে বলে, হেলিকপ্টার গার্দিখস গ্রাম অ্যাটাক করেছে। খুন-জখম হয়েছে বেশ কয়েকজন মানুষ। ওস্তাদের কপাল কুঁচকে ওঠে। তবে তিনি কিছু বলেন না। গাড়ি মাহমুদ-ই-রাকি শহরের মাঝামাঝি এলে দেখি, জমে উঠেছে চক। তামাশা দেখতে ঘোড়ার গাড়ি থামিয়ে আমরা পথে নামি। স্টিরিওতে জোরেশোরে বাজানো হচ্ছে জনপ্রিয় গায়ক আহমেদ জহিরের লিরিক, ‘ইয়ে দিল মিগে বেরাম বেরাম/ ইয়ে দেলাম মিগে নারাম নারাম/ বি তো চেকনাম।’—‘হৃদয় বলে যাও তার কাছে/ সমাজ বলে যেও না যেও না/ কাটাই কীভাবে জীবন তোমাকে ছাড়া।’ সুরলয়ের সঙ্গে সংগত রেখে জোশাল যুবকেরা দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে ডান্স করছে। পথের পাশে এক জায়গায় প্রকাণ্ড ডেগে করে নিয়ে আসা হয়েছে আখনি ও সুরুয়া। বাটা হচ্ছে গরিব-মিসকিনদের শিরনি।
এসব ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে আসি চকের নিরিবিলি ময়দানে। মাঠে খাটানো হয়েছে নাগরদোলা। তাতে ঘূর্ণিপাকে দুলছে কয়েকটি বালিকা। শহরের একমাত্র ট্রাফিক ছত্রীর সামনে আমরা একটু দাঁড়াই। ছেঁড়াখোঁড়া চাপান পরা একজন মানুষ ছত্রীর খিলানে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছেন। আমাদের সাড়া পেয়ে জেগে উঠে ফেরিওয়ালাদের মতো হাঁক পাড়েন তিনি, ‘লালজারি, মরকত, মালাগালারা…লালজারি, মরকত, মালাগালারা’ বা ‘চুনি, পান্না, মুক্তা।’ তাঁর হাতে আংটিবিক্রেতাদের মতো একটি কাচের কেইস। কিন্তু তার ভেতরে কিছু নেই। মানুষটিকে আগেও এ চকে হাঁক পাড়তে দেখেছি। এবার কৌতূহলী হয়ে ওস্তাদের কাছে জানতে চাই, ঘটনা কী? তিনি বলেন, অনেক বছর আগে ভদ্রলোক ফেরি করে বিক্রি করতেন চুনি, পান্না ও বৈদুর্যমণি। লোকজনের হাত দেখে গ্রহ-নক্ষত্র বিচার করে পাথরের বিধান দিতেন বলে তালেবানরা তাঁকে পুলেচরকির জিন্দানখানায় পাঠায়। তালেবি শাসনের পতনের পর কারাগার থেকে ছাড়া পান তিনি। কিন্তু নসিব খারাপ। যুদ্ধের সময় বোমাবর্ষণে পুড়ে গেছে তাঁর ভিটামাটি। মৃত্যু হয়েছে স্ত্রীসহ দুই সন্তানের। এতে তাঁর মনোবিকলন ঘটে, তবে ভুলতে পারেননি একসময়ের রঙিন রত্নরাজি বিক্রির স্মৃতি। এখনো মাঝেমধ্যে তিনি হাঁক পাড়েন, ‘লালজারি, মরকত, মালাগালারা…।’ শহরে ট্রাফিক ছত্রী কেবল একটি। তবে কি এখানে ঝুলিয়ে ফাঁসি হয়েছিল নাগমাগুলের স্বামীর?
ঘোড়ার গাড়িতে উঠতে গিয়ে ভাবি, ওস্তাদকে জিজ্ঞেস করব তারিখ আল-হিন্দ কিতাবের রচয়িতা আলবিরুনি কিছুদিনের জন্য বসবাস করেছিলেন এখানকার কোন গ্রামে? কিন্তু মুখ খোলার আগে আকাশের দিকে ইশারা দেন তিনি। দেখি মাথার ওপরে ভাসছে সিকিউরিটি ব্লিম্প বা একধরনের ক্যামেরা লাগানো নজরদারি বেলুন। নিমেষে থেমে যায় নাগরদোলা। ছোট্ট মেয়েগুলো চাদরে মুখ-মাথা ঢেকে তড়িঘড়ি ছুটে যাচ্ছে। ডান্স করনেওয়ালা যুবকেরা স্টিরিও বন্ধ করে কপালে হাত দিয়ে তাকাচ্ছে আকাশে। নজরদারি ব্লিম্পটি ভেসে এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে ঠিক তাদের নৃত্য-মহফিলের ওপরে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.