রোহিঙ্গাদের ত্রাণ কার্ডেই কোটিপতি সেলিম

0

শহিদুল ইসলাম, কক্সবাজার, সিটিনিউজ:: মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন দাতা সংস্থার দেয়া ত্রাণ বিতরনে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্ণীতির অভিযোগে উঠেছে।

কক্সবাজার ইউনিটের প্রকল্প সমন্বয়ক সেলিম আহমেদ এসব ত্রাণ অনিয়মে নেতৃত্ব দেন বলে দাবী অসংখ্য অসহায় ভুক্তভোগীর। শুধু তাই নয়, গরীবের টাকা মেরে রাতারাতি কোটি টাকার মালিকও বনে গেছেন অভিযুক্ত ওই ব্যক্তি।

এর আগে থেকে দীর্ঘদিন ধরে ত্রাণ বিতরণে হরিলুটের অভিযোগ উঠে আসছিল সেলিমের বিরুদ্ধে। তার বেপরোয়া দুর্নীতির কারণে বিডিআরসি’র কার্যক্রমের উপর নিরীহ দুস্থ মানুষের আস্থা উঠে যাচ্ছে।

আর ত্রাণ লুট করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন সেলিম আহমেদ। ত্রাণ বিতরণের সকল কার্যক্রমে নিয়োজিত যুব রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্যদের দেয়া তথ্যে দূর্নীতির ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে আসছে।

প্রাপ্ত সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর সেই দেশের সেনাবাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতনের কারণে দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, টেকনাফের লেদা নয়াপাড়া এলাকায় আশ্রয় নেয়।

মিয়ানমার সরকারের নির্যাতন শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সামগ্রি ‘ফুড ফ্রুটিলা’ পাঠায় মালয়েশিয়া। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সেই ফুড ফ্রুটিলা বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে।

ওই ফুড ফ্রুটিলা প্রোগ্রামে ৪৭৫ টন খাদ্য সামগ্রি ছিল। প্রতিটি প্যাকেটে চাল, ডাল, তেলসহ ৩৫ ধরণের খাদ্য সামগ্রি ছিল। সেগুলোকে ১৫ হাজার ২৫০ টি প্যাকেট করা হয়। পরে প্রতি পরিবারে একটি করে প্যাকেট বিতরণ করা হয়।

প্যাকেট বিতরণের আগে তালিকা করার সময় প্রতি পরিবারে একটি করে কার্ড দেওয়া হয়। ওই সময় প্রতিকার্ডে উপকারভোগির কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে আদায় করা হয়।

সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বিতরণের জন্য দেওয়া হলেও প্যাকেট প্রতি রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে আদায় করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে খোদ জেলা ইউনিটের ম্যানেজিং কমিটি।

জানা গেছে, বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম দেখাশুনা করেন কক্সবাজার জেলা ইউনিটের ডাইজেস্টার রেসপন্স প্রোগ্রামের সমন্বয়ক সেলিম আহমেদ।

সেলিম আহমেদ বিনামূল্যের ফুড ফ্রুটিলা প্রোগ্রামে ১৫ হাজার ২৫০ রোহিঙ্গা পরিবারের কাছ থেকে ১ কোটি সাড়ে ৫২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই টাকার ভাগ সরাসরি বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি সদর দপ্তরের রিলিফ বিভাগের পরিচালক নাজমুল আজম খানের নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।

একারণে ওই দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার আসেনি। সূত্র মতে, এমআরআরও প্রকল্পে কুতুপালং ক্যাম্পের নিবন্ধিত ৬ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা পরিবারকে ত্রাণ সামগ্রি দেওয়া হয়। এই ননফুড প্রকল্পের ৬ হাজার ৫০০ উপকারভোগি পরিবারের কাছ থেকেও আদায় করা হয়েছে ১ হাজার টাকা করে। সেখানে সেলিম আহমেদ দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন ৬৫ লাখ টাকা।

এই প্রকল্পটি বর্তমানেও চলমান। পপুলেশন মুভমেন্ট প্রোগ্রামে ৫ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারকে খাদ্য সামগ্রির প্যাকেট দেওয়া হয়। সেখানে প্রতি প্যাকেটে সাড়ে ৬ হাজার টাকার খাদ্য সামগ্রি ছিল। ওই প্রকল্পেও প্যাকেট প্রতি ১হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন সেলিম আহমেদ। পপুলেশন মুভমেন্ট প্রোগ্রাম থেকে সেলিম সিন্ডিকেট লুটে নিয়েছেন প্রায় ৫০ লাখ টাকা। যদিও এসব প্রকল্পের ত্রান গুলো বিনামূল্যে দেওয়ার কথা।

জানা গেছে, বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির (বিডিআরসি) দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা সেলিম আহমেদ দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে কক্সবাজার ইউনিটে কর্মরত রয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে একটি ইউনিটে ৫ বছরের বেশি সময় থাকার নিয়ম না থাকলেও ২৭ বছর ধরে বহাল রয়েছেন সেলিম আহমেদ।

দীর্ঘ এই সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছেন তিনি। জনশ্রুতি রয়েছে-তাকে সরাসরি সহযোগিতা করেন সদর দপ্তরের রিলিফ বিভাগের পরিচালক। একারণে বহুবার অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার আসেনি।

সূত্রে জানা গেছে, ফুড ফ্রুটিলার ত্রাণ বিতরণের সমন্বয়ক ছিল বিডিআরসির কর্মকর্তা সেলিম আহমেদ। ওই ত্রাণ গুলো বিতরণে খরচ হয়েছে ১০ লাখ টাকা। কিন্তু সেখানে ত্রাণ বিতরণে ভুয়া খরচ বিল করা হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। বাকি ১৫ লাখ টাকা ভুয়া বিল করে হাতিয়ে নেয়ার পায়তারা করে সেলিম সিন্ডিকেট। আর তাঁর এই দুর্নীতিতে সরাসরি ইন্ধন দিচ্ছে বিডিআরসির সদর দপ্তরের রিলিফ বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা।

জানা গেছে, ফুড ফ্রুটিলার ত্রাণ বিতরণের সময় বিডিআরসির কর্মকর্তারা কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প যাতায়াতের জন্য দুইটি মাইক্রোবাস ভাড়া নেয়। প্রতিটি মাইক্রোবাস দৈনিক ৪ হাজার টাকা করে ২৭ দিনে দুই মাইক্রোবাসের বিল আসে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। লোডিং খরচ ধরা হয়েছে প্রতি টন ৭০ টাকা করে ৩৩ হাজার ২৫০ টাকা। আনলোডিং খরচ ধরা হয়েছে টন প্রতি ৮০ টাকা করে ২৮ হাজার টাকা।

প্যাকেজিং মজুরি প্রতি প্যাকেট ১৪ টাকা করে ২ লাখ ২৪ হাজার টাকা। ট্রাক ভাড়া প্রতি টন ৩০০ টাকা করে ২৭ দিনে ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। প্রতি বস্তা ৯ টাকা করে ৪১ হাজার টাকা। অফিসার ভাতা জন প্রতি দৈনিক ১ হাজার টাকা করে চারজনের ভাতা ১ লাখ ৮ হাজার টাকা। আরসিওয়াই ভাতা ২ লাখ টাকা। পলিথিন বিল ৩০ হাজার টাকা। বিবিধ খরচ ধরা হয়েছে ১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

কিন্তু রহস্যজনকভাবে টাকা আত্মসাতের জন্য বিল করা হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। এসব প্রোগ্রামে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য নন ফুড সামগ্রীর মধ্যে, সাবান, মশারী, তৈল, কেরোসিন, বালতি, কোকারীজ সামগ্রী এবং নারীদের অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী হাইজিন কিডস ইত্যাদি বিতরণ করা হয়।

জানা যায়, বিগত ৪ বছর পূর্বে এ প্রকল্পের দায়িত্বে থাকার সুবাধে যোগদানের প্রথম বছর থেকেই শুরু হয় সেলিমের দূর্নীতি। নন ফুড সামগ্রীর অর্ধেকেরও বেশি ত্রাণ দালালের মাধ্যমে বাহিরে বিক্রয় করে অবশিষ্ট মালামাল রোহিঙ্গাদের মাঝে নামে মাত্র বিতরণ করে আসছে। এতে ক্রমান্বয়ে পকেট ভারী হয়ে উঠেছে আর বঞ্চিত হচ্ছে মিয়ানমার সরকারের দমন নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা।

সেলিম আহমেদ যোগদানের প্রথম বছরেই এমআরআরও প্রকল্পে ভয়াবহ দূর্নীতি শুরু করলে সেসময় প্রকল্পটিতে কর্মরত ব্যক্তিরা তার বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগে আন্দোলন শুরু করেন। সেলিম আহমেদ বর্তমানে বর্তমানে এমআরআরও প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্বে রয়েছেন। তার দূর্নীতির বিরুদ্ধে সদর দপ্তরেও লিখিত অভিযোগ করেন আন্দোলনকারীরা। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জানা গেছে, হাইজিন কিডস সামগ্রী ত্রাণ বিতরণের জন্য উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত ক্যাম্পের জন্য ৩০০ কার্ড বরাদ্ধ দেওয়া হয়। ওই কার্ডের বিপরীতে সেখানে আরসিওয়াই কর্মী দিয়ে তালিকাও করা হয়। কিন্তু একদিন পর নিজস্ব লোক দিয়ে টাকার বিনিময়ে কার্ড গুলো অন্য রোহিঙ্গাদের কাছে বিতরণ করে। এতে অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয় বিপুল পরিমাণ টাকা।

জানা গেছে, ওই কার্ড অনুযায়ী বিতরণের দিন আরসিওয়াই কর্মীরা কুতুপালং ক্যাম্পে যায়। কিন্তু সকালে তাদের কাছ থেকে ক্যাম্পের বাইরে স্বাক্ষর নিয়ে তাড়িয়ে দেয়। তাদেরকে ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি।

এসব ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন কক্সবাজার যুব রেডক্রিসেন্ট এর প্রধান মোহাম্মদ হোসাইন মাসুমসহ অন্যান্যরা। তারা বলেন, তাদেরকে বিতরণের জন্য নিয়েও গেলেও মূলত স্বাক্ষর নিয়ে তাড়িয়ে দেন সেলিম আহমেদ।

পরে ওই সেলিম আহমেদ সেগুলো প্রকৃত উপকারভোগিদের দেয় না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত সেলিম আহমেদ জানান, এসব তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এ ধরণের কোন অনৈতিক কাজের সাথে তিনি জড়িত নয় বলে দাবী করেন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.