একজন সময়ের সাহসী শ্রমকি নতা হাজী মকবুল

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ  রাজপথ তাকে ডেকেছে আয়, আয়। ষ্টিয়ারিং তাকে টেনেছে কাছে, আরো কাছে। কখন কোন ফাঁকে ডিজেল পোড়া হাতে উঠে এসেছে কলম। নিরবে-নিভৃতে থেকে অবশেষে লোকালয়ে এসেছেন মকবুল আহমদ।

বৃটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ-এই ত্রিকাল পরিদর্শী ৮০ বছর বয়সী শ্মশ্রুমন্ডিত মানুষটি জন্মেছেন ১৯৩৭ সালে এদেশেরই এক সাধারণ কৃষক পরিবারে। ৫০ সালে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। আশ্রয় নিয়েছিল অনেক জায়গায়।

ট্রাক দেখে সখ জেগেছিল চালক হবার। সেই থেকে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সৌদি আরবের পথ থেকে পথে চালিয়েছেন ট্রাক, ট্রেইলার, ট্যাংক লরী, প্রাইভেট কার স্কুটার। আশির দশকে জড়িয়ে পড়েন পরিবহন শ্রমিক রাজনীতিতে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক, ট্যাংক লরী ড্রাইভার এ্যান্ড এসিসট্যান্ট ইউনিউনের প্রতিষ্টাতা এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

দীর্ঘ ৩৭ বছরের লব্দ অভিজ্ঞতায় ড্রাইভার হেলপারদের সামাজিক মর্যাদা প্রদানসহ পরিবহন শিল্পের সমস্যা সমাধানে এখনো সোচ্চার। বিভিন্ন সময় পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে লিখেছেনও।

জীবন যুদ্ধের লড়াইয়ে সংকল্পবদ্ধ মকবুল আহমদের সঙ্গে আমার পরিচয় নব্বই দশকের গোড়ার দিকে। তিনি এসেছিলেন আজকের সুর্যোদয়ের প্রধান সম্পাদক খোন্দকার মোজাম্মেল হকের রেফারেন্সে। সাধা সিধে জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত মানুষ মকবুল সাহেব থাকতেন নগরীর মাদারবাড়িতে। আমার সাংবাদিকতা জীবনে আজকের সুর্যোদয়ে কর্মরত অবস্থায় প্রথম দিকে আমার সাথে তার অনেক সময় কেটেছে।

যেখানে এ্যাসাইনমেন্টে যেতাম তিনি আমার সঙ্গী হতেন। আমার চেয়ে বয়সে বড় হলেও দুজনের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মত। ৮০ বছর বয়সেও কয়েকদিন আগে তিনি এসেছিলেন আমাকে দেখতে। একবার তাকে নিয়ে গেলাম চট্টগ্রামের অভিসংবাদিত নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে।

তখন তিনি নগর পিতা। মুষলধারে বৃষ্টিতে কাকভেজা দুজনের দেখা হয়েছিল মেয়রের সঙ্গে। প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে তিনি দুজনকে গাড়িতে তুলে নিয়েছিলেন। বিশাল গোলাকার মুখভরা সাদা দাড়িতে মকবুল আহমদকে দেখিয়ে মেয়র বলেছিলেন,’এই দরবেশ কড়ে পাইলি! বললাম,’ তিনি শ্রমিক নেতা।

অফিসে এনে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিলেন তিনি। মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছিলেন,’ মকবুল ভাই একজন ত্যাগী নেতা তার চেহারা দেখেই বুঝে নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সাংবাদিক মহলে তার উঠাবসা ছিল খুব বেশি। আমার অগ্রজ সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ, মরহুম আখতারুন্নবী, বেলাল ভাই, ফারুক ইকবাল, রয়টার্সের নিজাম ভাইসহ অনেক গুনী সাংবাদিকদের সঙ্গে ছিল তার সখ্যতা।

হাজী মকবুল আহমদ ’ঘাতক নয় সেবক’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ লিখেছেন। পুথিগত বিদ্যায় বেশিদুর না গেলেও তার মধ্যে ছিল যথেষ্ট মেধা ও যোগ্যতা। বাংলা ভাষায় যথেষ্ট দখল। অসম্ভব প্রতীভার পরিচয় দিয়েছে তার লেখা গ্রন্থে।

পত্র পত্রিকা ও লেখালেখির প্রতি ছিল তার অদম্য আগ্রহ। কোন লোভ লালসা ছিল না। সবসময় হাস্যোজ্জল এ মানুষটি ঘুরে বেড়িয়েছেন মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে রাজপথে। অন্যায় অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে তিনি গর্জে উঠেছেন বার বার। কখনো কোন অন্যায় আবদারের কাছে তিনি নতি স্বীকার করেননি।

চট্টগ্রামে নবীন-প্রবীন সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবিদের একটি বড় অংশ তাকে ভালভাবে চেনেন। সম্পর্কটি ছিল অকৃত্রিম। পরিবহন সেক্টরের শ্রমিকদের নিয়ে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে। কষ্টসহিষ্ণু মকবুল আহমদ সাংবাদিকবান্ধব একজন খাঁটি মানুষ। জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও সময় হলে খোঁজখবর নেন সাংবাদিকদের।

শরীরে নানা রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে। সুযোগ হলে এখনো ছুটে যান তিনি বন্ধুমহলের আড্ডায়। যার অন্তরজুড়ে ভালবাসা। ভাবেন বন্ধুদের কথা, দেশের কথা, মেহনতি মানুষের কথা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক মকবুলের গভীর দেশাত্ববোদ ও সাংবাদিক সমাজের প্রতি ভালবাসা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত জ্বলছে আলো ছাড়িয়ে।

হাজী মকবুল পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে কাটিয়েছেন জীবনের সোনালী দিনগুলো। এ কারনে জেল জুলুম ও অত্যাচার সহ্য করেছেন। হাজী মকবুল আহমদ তার লেখা বইতে লিখেছেন, ’আমি একজন পরিবহন কর্মী। দীর্ঘ ৩৫ বছরের শ্রমজীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, ঘটনা-দুর্ঘটনা, সমস্যা-সংকট মোকাবেলা করেছি।

’ঘাতক নয় সেবক’ নামের বইটি মকবুল আহমদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফসল। দীর্ঘদিন তিনি পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে কাজ করেছেন। খুঁব কাছ থেকে দেখেছেন শ্রমিকদের অন্তর কষ্টের নানা দিক। তাদের প্রতি গভীর মমতা ফুটে উঠেছে ’ঘাতক নয় সেবক’ বইটির পাতায় পাতায়। ভেবেছেন দেশ রাজনীতি ও সমাজ সেবা নিয়েও।

তার ভাবনার জগতে ঘুরে ফিরে সেই শ্রমিকদের মুখচ্ছবি ভেসে উঠেছে। এ দেশের পরিবহন সেক্টরে ধুলাবালি ও ঝড় বৃষ্টির সাগর মাড়ি দিয়ে ছুটে চলা শ্রমিকরা রেখে চলেছেন দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বিশাল অবদান। তারাও মানুষ যাদের হৃদয় জুড়ে আছে প্রচন্ড দেশপ্রেম।

জীবন ও জীবিকার তাগিদে তারা ছুটে চলেন পথ থেকে রাজপথে। যানবাহনের নানা সমস্যা, পরিবহন শ্রমিকদের ঘাত-প্রতিঘাত উঠে এসেছে তার লেখায়। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন মানবতাবাদী, শ্রমিকবান্ধব ও গরীবের বন্ধু মকবুল আহমদের ব্যক্তি চরিত্রের উৎকর্ষতা খুঁজে পাওয়া যাবে তার ’ঘাতক নয় সেবক’ গ্রন্থে।

কোন লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক বা কলামিষ্ট না হয়েও নিজের অর্থের বিনিময়ে লিখেছেন বই। এই বইটি পরিবহন সেক্টরে বেশ আলোচিত হয়েছে। একজন মানবদরদী মানুষ হিসেবে হাজী মকবুল শ্রমিক জনতার অন্তরের অন্তস্থলে স্থান নিয়েছেন।

চট্টগ্রামের অভিসংবাদিত নেতা আলহাজ্ব এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, আতাউর রহমান খান কায়সার, ইসহাক মিয়া, ওবায়দুল কাদের, জয়নাল হাজারীসহ অনেক খ্যাতিমান রাজনীতিকের সঙ্গে মকবুল আহমদের ছিল সুসম্পর্ক।

একবার আমার সঙ্গে ফেনি গিয়েছিলেন জয়নাল হাজারীর সাক্ষাৎকার গ্রহন করতে। তৎকালীন এমপি জয়নাল হাজারী হাজী মকবুল আহমদকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,’ ভাইছা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে-আন্নে বড় নেতা অইতে পারবেন’। মকবুল সাহেব বলেছিলেন,’ রাজনীতি নয় মানবতার সেবাই আমার আদর্শ। মানুষের পাশে থাকতে চাই’।

হাজী মকবুল আহমেদের পুত্র আহমেদ রহিম। নব্বই দশকে সাংবাদিকতা দিয়ে যার জীবন শুরু। এরপর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। যার ধারাবাহিকতায় এখন যুবলীগের রাজনীতিতে অগ্রনী ভুমিকা রাখছেন। কঠোর শ্রম ও সততার বদৌলতে ব্যবসায়ও সফলতা দেখেছেন আহমেদ রহিম।

পিতার আদর্শ ও বিশ্বাসের পথে হেঁটেছেন রহিম। সাথে পিতার দোয়া, স্নেহ ও ভালবাসা। মামলা, হুলিয়া, নির্যাতন ও রক্তচক্ষু সব প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে সামনে চলেছেন রহিম। পিতা মকবুল আহমেদ প্রতি মুহুর্তে গাইড করেছেন ছেলেকে। যে কারনে আহমেদ রহিম মুক্তিযুদ্ধের চেতণায় মুজিবাদর্শের এক অকুতোভয় সৈনিক।

তাদের জীবনের আনন্দ বেতনার পথচলায় আমি সহযাত্রী হতে পেরে আনন্দিত। আল্লাহ তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়ে মানুষের সেবা করার সুযোগ দেবেন। সেই শুভকামনা সবসময় করি। প্রবীন শ্রমিক নেতা হাজী মকবুলকে আল্লাহ আমাদের কাছে জাগ্রত রাখুক চিন্তা-চেতণা, মেধা ও মননে যুগ পরম্পরায় সুন্দর পৃথিবীর নান্দনিক পরিবেশে। তিনি দীর্ঘজীবি হোন। এ কামনা ও প্রত্যাশা করছি পরমকরুনাময় আল্লাহর কাছে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.