মহাসড়কে পন্য লোপাটঃ সক্রিয় ৪০ সিন্ডিকেট

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রতিনিয়তই কাভার্ডভ্যান থেকে পণ্য লোপাট হচ্ছে। একটি চক্র চালক হেলপারের সহযোগিতায় পণ্য লোপাট করে যাচ্ছে। এভাবে বছরে অন্তত অর্ধশত কোটি টাকার পণ্যলোপাট হয়। গত মাসের শেষের দিকে তিন অভিযানে কোটি টাকার পণ্য উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ সময় গ্রেপ্তার হয়েছে ১১ জন। পণ্য চুরির কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন আমদানী-রপ্তানীকারকরা। এদিকে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ৩৫ থেকে জন এ অপকর্মে জড়িত। তারা প্রত্যেকে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে।

জানা যায়, গত ২৯ নভেম্বর ভোরে লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া বাজার থেকে একটি কাভার্ডভ্যান উদ্ধার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এর দুইদিন আগে সদরঘাট এলাকা থেকে গাজীপুর যাওয়ার পথে কাভার্ডভ্যান সহ আমদানী পণ্য চুরি হয়েছিল। কাভার্ডভ্যানে ১৭৩ কার্টন পণ্য থাকলেও উদ্ধার করা গেছে ১৫১ কার্টন। ২২ কার্টন সরিয়ে ফেলেছে লোপাটকারীরা। তবে এ ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

পুলিশ জানায়, গত ২৬ নভেম্বর সদরঘাট থানার কদমতলী এলাকা থেকে টিভিএস কোম্পানীর যন্ত্রাংশ নিয়ে গাজীপুরের টঙ্গীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয় একটি কাভার্ডভ্যান। পথে চালক ও সহকারী চোর চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগসাজসে কাভার্ডভ্যান সহ পণ্য চুরি করে পালিয়ে যায়। এর আগে বন্দর থানার মাইলের মাথা এলাকায় এন এন এক্সপ্রেস নামে একটি কুরিয়ার সার্ভিস থেকে এক হাজার ৯০০ সেট তৈরী পোশাক উদ্ধার করা হয়। এগুলো বন্দরে আনার পথে কাভার্ডভ্যান থেকে লোপাট হয়েছিল। এ ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো, মো: কাশেম (৪৩), মো: রাশেদ (২৮), মো: কাউছার হোসেন (৩০), মো: সাজ্জাদ হোসেন ওরফে সাদ্দাম (২৬), শাহাদাত হোসেন (২৯) ও আনোয়ার হোসেন (২৯)।

পুলিশ জানায়, কাভার্ডভ্যানে ৮৮০ কার্টনে ২৪ হাজার ৬৪০ সেট তৈরী পোশাক বিদেশে রপ্তানির জন্য পাঠানো হয়েছিল। কাভার্ডভ্যানটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসার পথে মিরসরাইয়ের চিনকি আস্তানা এলাকায় আনোয়ারুল আজিম বাবু নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে নিয়ে যায় চালক। সেখানে বিভিন্ন কার্টন থেকে চার হাজার ৫৬৮ সেট পোশাক লোপাট করা হয়। এ ছাড়া লোপাট হওয়া ৩০ লাখ টাকার তুলা উদ্ধার করে পুলিশ। এসব তুলা গাজীপুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় ৫ জনকে। তারা হল, মো. জসিম উদ্দিন পাটোয়ারী (৩৫), মো. সাইফুল্লাহ প্রকাশ সাইফুল (৪৮). মো. রনজু মিয়া (৫০) ও মো. সানোয়ার হোসেন (৪৫)।

অনুসন্ধান ও পুলিশ সুত্রে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পন্য চুরির ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। এ মহাসড়কে বছরে অর্ধশত কোটি টাকার পন্য লোপাট হয়। এমনকি লোপাটে বাধা দিতে গিয়ে তাদের হাতে চালক-হেলপারের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। গ্রেপ্তারকৃতরা পুলিশকে জানিয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কাভার্ডভ্যানে পরিবহন করা রপ্তানীপন্য লোপাট চক্রে রয়েছে কাভার্ডভ্যান চালক, চালকের সহকারী, ব্যবসায়ী, দোকানদার, ডিপো মালিক, নিরাপত্তাকর্মী, শ্রমিক, ক্রেতাসহ ৩৫ থেকে ৪৯ জনের একটি চক্র। ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, সাভার, চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন এলাকায় তারা ছড়িয়ে আছে। লোপাটের জন্য টার্গেট করা হয় ঢাকা বা অন্য জায়গা থেকে রপ্তানীর জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরুর পর।

এ চক্রের সদস্য কাভার্ডভ্যান চালক, সহকারী চট্টগ্রামে অবস্থান করা অন্য সদস্যদের প্রথমে ফোন করে চালানের তথ্য জানায়। পন্যের পরিমানও জেনে নেয় তারা। তারপর সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তারা আরও জানায়, কাভার্ডভ্যান কুমিল্লা, মিরসরাই, সীতাকুন্ড বা চট্টগ্রাম নগরীতে প্রবেশ করার পর সুযোগ বুঝে পন্য লোপাটের কাজ শেষ করা হয়। এসব জায়গায় তাদের নির্ধারিত ডিপোতে কাভার্ডভ্যান ঢুকিয়ে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টার মধ্যেই চুরির কাজ শেষ করে।

কাভার্ডভ্যানের সিলগালা করা তালা না ভেঙ্গে তারা দরজার নাট খুলে ফেলে। তারপর ভেতরে থাকা কার্টন থেকে অর্ধেক পণ্য সরিয়ে নিয়ে পুনরায় স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়। কোনো কার্টন থেকেই সব পণ্য সরানো হয় না। তিন ভাগের এক ভাগ বা অর্থেক পণ্য সরানো হয়। নগর গোয়েন্দা পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, পণ্য লোপাটকারী চক্রটি শক্তিশালী। তাদের দলে ৪০ জনেরও বেশি সদস্য রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে চালক-হেলপারও জড়িত থাকে। ডাকাত দলকে তারাই ইনফরমেশন দেয়। সে অনুযায়ী পণ্য লোপাট করে নির্বিঘ্নে চলে যায়। তিনি বলেন, আমরা তাদের দলের ৮ থেকে ১০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছি। তারা তথ্যও দিয়েছে। বাকিদের ধরতে কার্যক্রম চলছে।
পুলিশ জানায়, নির্দিষ্ট ক্রেতার কাছেই এসব পণ্য বিক্রি করে তারা। বাজার দরের চেয়ে কম দামে বিক্রি করা হয় এসব পণ্য।

জানা গেছে, বিষয়টি চট্টগ্রাম চেম্বারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়কে চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, আমদানি-রপ্তানির জন্য কোটি কোটি টাকার পণ্য বন্দরে আনার সময় একটি চক্র কৌশলে চুরি করে নিয়ে যায়। এতে আমদানী রপ্তানীকারকরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। চিঠিতে নিরাপদে যাতে পন্য আনা নেওয়া করা যায় সেজন্য পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।

জানা গেছে, মিরসরাই থেকে কাচপুর ব্রিজ পর্যন্ত কখনো সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে, কখনো আবার গাড়ির কাঁচে পাথর ছুড়ে পাড়ি থামাতে বাধ্য করে। এ সময় দু-তিনজন চালকের সাথে তর্কাতর্কি করতে থাকে। এ সুযোগে পেছনে কয়কজন গাড়িতে উঠে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে কার্টন খুলে একের পর এক তৈরী পোশাক বা অন্য মালামাল নিয়ে সটকে পড়ে। লোপাটের তালিকায় তৈরী পোশাক, পোশাক তৈরীর কাঁচামাল তুলা, রোল কাপড়, মসলা, গম, চাল, ডাল সহ নানাবিধ পণ্যবাহী গাড়ি রয়েছে। ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের মতে, সড়কে পণ্য লোপাট হওয়ার কারনে ব্যবসায়ীরা মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এ ব্যাপারে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তারা দীর্ঘদিন ধরে দাবী জানিয়ে আসছেন। পণ্য চুরির কারনে পোশাকশিল্প মালিকরাই বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, মহাসড়কে একটি সংঘবদ্ধ চক্র প্রতিনিয়তই পণ্য লোপাট করছে। গ্রেপ্তারৃতদের কাছ থেকে এ চক্রের তথ্য মিলেছে। কারা মুল হোতা তাও আমরা জানতে পেরেছি। তাদের শিগগির আইনের আওতায় আনা হবে। হাইওয়ে পুলিশের এ এস পি মো: ফরহাদ বলেন, এ ধরনের পন্য লোপাটের ঘটনা ঘটে বলে শুনেছি। তবে সেটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। যারা মালামাল উদ্ধার করেন তারাই তদন্ত করেন। বিষয়টি থানা পুলিশ বা গোয়েন্দা পুলিশই দেখে।

তবে আমাদের সীমানার মধ্যে ঘটলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিই। চট্টগ্রাম জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক গ্রুপের সভাপতি আব্দুল মান্নান বলেন, একটি সংঘবদ্ধ চক্র ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান থেকে পণ্য ছিনতাই করে নিয় যায়। তারা অস্ত্রের মুখে চালক হেলপারদের জিম্মি করে মালামাল লুট করে। বিষয়টি আমরা পুলিশকে বার বার জানিয়েছি। তিনি বলেন, কোন চালক বা হেলপার জড়িত থাকার প্রমান পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। ডাকাত ও ছিনতাইকারীরাই রাতের বেলায় পণ্য লুটপাট করে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, বিষয়টি আমরা সরকারের উচ্চপর্যায়ে অবহিত করে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.