যে কারনে জঙ্গিদের হিডলিষ্টে বাবুল আকতার

গোলাম শরীফ টিটু : চট্টগ্রাম উত্তর, মহানগর ও পর্যটন শহর কক্সবাজারে কর্মদক্ষতা, সাহসীকতা ও সৎ পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে প্রশংসিত হয়েছিলেন বাবুল আক্তার। সর্বশেষ তিনি দায়িত্ব পান নগর পুলিশের উপ-কমিশনারের। সেখানেও নতুন ইতিহাস গড়লেন তিনি। ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার বাংলাবাজারে মাজারে ঢুকে ল্যাংটা ফকির ও আবদুল কাদের নামে দুজনকে নৃশংসভাবে জবাই করে খুন করা হয়। হত্যাকারী এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তার পর বিকট শব্দে বিস্ফোরন ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। ২৩ সেপ্টেম্বর নগরীর মাঝিরঘাট এলাকায় একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলে ছিনতাইকারীদের নিজেদের ছোঁড়া বিস্ফোরনে মারা যায় দুই ছিনতাইকারী।

ছিনতাইয়ের শিকার গুরতর আহত সত্য গোপাল ভৌমিক পরদিন মারা যান। সদরঘাট থানা পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। নিহত ছিনতাইকারীদের পরিবারের খোঁজ না পাওয়ায় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম লাশগুলো দাফন করে। ঘটনস্থলে একটি মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। বেশ কিছুদিন সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ তদন্ত চালিয়ে রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হলে তদন্তভার ন্যস্ত হয় তৎকালীন এডিসি ডিবি বাবুল আকতারের উপর। তার টিম নিয়ে কাজে নেমে পড়েন তিনি। প্রথমেই দৃষ্টি দেন মাঝিরঘাটের ঘটনাটির দিকে। খালি চোখে যেটি ছিনতাই বলে ধারনা করছিল সবাই। বাবুল আকতারের অনুসন্ধানে ঘটনাস্থলে বিস্ফোরক হিসেবে কিছু আলামত পাওয়া যায়। যা ছিনতাইকারীদের ব্যবহার করার কথা নয়। তদন্ত এগিয়ে যায়। জানা যায়, বিস্ফোরক ছাড়াও অপারেশনে সেদিন একে ২২ রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছিল। নড়েচড়ে বসে চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তাগন। কেউ কেউ আবার বলছিলেন এসব বাবুল আক্তারের বাড়াবাড়ি। এ ঘটনার ১৩ দিন পর তিনি দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন। তাদের কাছ থেকেই তথ্য পান ছিনতাইয়ের ঘটনাটি ঘটিয়েছে জেএমবি।

জঙ্গি তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই জেএমবি এ ঘটনা ঘটায়। ৬ অক্টোবর নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজ নগর এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে জেএমবির চট্টগ্রামের সামরিক কমান্ডার জাবেদ সহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয় বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে। ওই দিন জঙ্গিরা তার দিকে গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছিল। পরদিন গ্রেফতার জাবেদকে নিয়ে অক্সিজেন কুয়াইশ সড়কে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে গ্রেনেড বিস্ফোরনে জাবেদ মারা যান। গ্রেফতারে বাকি চার জঙ্গি আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী দেন। চারজন হল-বুলবুল আহমেদ ওরফে ফুয়াদ, সদস্য মো: সুজন ওরফে বাবু, মাহবুব ও শাহজাহান কাজল। এতে তারা স্বীকার করেন যে, তহবিল সংগ্রহের জন্য তারা ছিনতাইয়ে নেমেছেন এবং সেদিন মাঝিরঘাটের কাজটা ছিল তাদের। সুজন ওরফে বাবু স্বীকার করে, মাজারে ঢুকে ল্যাংটা ফকির ও আবদুল কাদেরকে খুন করেছে সে। কাফেরকে খুন করলে জান্নাতবাসী হওয়া যায় এমন ধারনা থেকেই সুজন ল্যাংটা ফকিরকে খুন করে। আর তাকে বাঁচাতে এসে খুন হয়েছে খাদেম আবদুল কাদেরও। একই সাথে তারা এও জানান তাদের কমান্ডার রাইসুল ওরফে ফারদিন।

ফারদিনের খোঁজে সাঁড়াসি অভিযান চালাতে থাকেন বাবুল আক্তার চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর হাটহাজারী আমানবাজার এলাকায় জেএমবির চট্টগ্রাম প্রধান রাইসুল ইসলাম ওরফে ফারদিনের ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে অত্যাধুনিক রাইফেল, বোমা তৈরীর বিভিন্ন সরঞ্জামসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর নথিপত্র ও সেনাবাহিনীর পোশাক উদ্ধার করা হয়। বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে ওই অভিযানে গ্রেফতার হন ফারদিনের তিন সহযোগি। তারা তিনজনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তিনজনই বর্তমানে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক আছেন। স¤প্রতি ফারদিন বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। বান্দরবানের দুর্গম এলাকানাইক্ষ্যংছড়িতেও অভিযান পরিচালনা করে জঙ্গী আস্তানা ধ্বংস করেন তিনি। বাবুল আক্তারের আস্থাভাজন পুলিশ কর্মকতার মতে, ফারদিন মারা যাওয়ার আগে বেশ কয়েকবার তাকে অনুসরন করার প্রমান পেয়েছিলাম আমরা মোবাইল ট্র্যাকিং করতে গিয়ে। কখনো তার বাসার সামনে, কখনো আবার তিনি বিমানে ঢাকা বিমানবন্দরে নামার আগে পরে ফারদিনের মোবাইল নেটওয়ার্ক বিমানবন্দরে পাওয়া গিয়েছিল।

কিন্তু বাবুল আক্তারের একটাই কথা, এদের ভয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে, বাংলাদেশ আর স্বাধীন হওয়া লাগতো না। একের পর এক অভিযানে জঙ্গীদের নেটওয়ার্ক দুর্বল করতে বিশেষ ভুমিকা রাখছিলেন সাহসী এই পুলিশ কর্মকর্তা। এসব ঘটনায় তার সাহসী পদেক্ষপ বাহিনীর অন্য দসদ্যদেরও সাহসী করে তোলে। গত এক দশকে দৃশ্যমান তৎপরতা না থাকলেও জামায়াতুল মোজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামের ভয়ংকর জঙ্গী সংগঠনটির অস্তিত্ব যে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি চট্টগ্রামে সেটি প্রমান করেছিলেন তৎকালীন নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বাবুল আকতার। শুধু তাই নয় জঙ্গিদের নতুন করে সংঘটিত হওয়ার ছকটা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন বাবুল আক্তারই। এ কারনে তিনি বারবার টার্গেট ছিলেন। স¤প্রতি চাপাইনবাবগঞ্জে ধরা পড়া জেএমবির সদস্যদের হিডলিষ্টেও তার নাম ছিল বলে তার সহকর্মী সন্তোষ চাকমা জানিয়েছেন। তিনি বলেন,’ জঙ্গিদের ধরার পর বাবুল আক্তার তাঁর পরিবার নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন থাকতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, তাঁকে মারতে না পারলেও জঙ্গিরা তার পরিবারকে শেষ করে দিতে পারে। বাবুল আক্তারের ঘনিষ্ট নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর) কাজী মুত্তাকী ইবনু মিনান বলেন, আমরা উনাকে বলেছিলাম আপনি ঢাকায় চলে যাচ্ছেন, ভাবীকে এখানে ফেলে যাচ্ছেন কেন? উনি বলতেন আপনার ভাবীকে কে কি করবে, করলে তো আমাকে করবে। বলতেন, আপনার ভাবী তো চট্টগ্রাম ছাড়তে চান না। তবে ঢাকায় গিয়ে সবদিক গুছিয়ে তারপর স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে জাবার কথা বলেছিলেন বাবুল আক্তার।

সেখানে থাকা নগরীর পাঁচলাইশ থানার ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন,’আমার পরিবারকে কেন দেখে রাখা হয়নি? আমি তো আগেই বলেছিলাম তারা আমার পিছু ছাড়বে না। জঙ্গি দমনে সক্রিয়ভাবে কাজ করা এই পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় পুলিশী নিরাপত্তা পর্যাপ্ত ছিল কিনা, জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপ-কমিশানার (উত্তর) পরিতোষ ঘোষ বলেন, দুজন পুলিশ সদস্য সার্বক্ষনিক তার বাসার নিরাপত্তায় ছিলেন। ঘটনার আগেরদিন সন্ধ্যায় তারা বাসা থেকে চলে আসেন। ঘটনার দিন সকালে আবার বাসায় যেতেন। এ সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ২০০৫ এ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে সারদা একাডেমিতে ট্রেনিং শেষে কর্মজীবন শুরু করেন র‌্যাব-২ এ।

২০০৮ ও ২০০৯ সালে সেবা ও সাহসীকতার স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক। ২০১১ তে পান পুলিশের সর্বোচ্চ পুরস্কার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল। আর শেষ পদোন্নতি পেয়ে তিনি কাজ শুরু করেছেন পুলিশ সদর দপ্তরে। সা¤প্রতিক সময়ে জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে তার সাহসী অবদানের কারনে সারাদেশেই তিনি আলোচিত। তার স্ত্রী হত্যার ঘটনায় জঙ্গিদের দিকে সন্দেহের আঙ্গুল তুলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বলেছেন, বাবুল আক্তার একজন দক্ষ, সৎ অফিসার এবং জঙ্গি দমনে প্রচুর কাজ করেছে।তাই তাকে না পেয়ে তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.