মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধন:মানুষের আহাজারীতে ভারী বাতাস

0

জুবায়ের সিদ্দিকী-

বিবিসি জানায়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের ঘটনায় দেশে দেশে প্রতিবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশের পর মিয়ানমারের রাষ্ট্রদুতকে তলবের ঘোষণা দিয়েছে মালয়েশিয়া। অং সান সুচির নোবেল প্রত্যাহারের দাবী এসেছে ইন্দোনেশিয়া থেকে। বিক্ষোভ হচ্ছে থাইল্যান্ডে। অং সান সুচির নিরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক মানবাদিকার সংস্থাগুলো। বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। অং সান সুচির মত গনতন্ত্রের ছদ্মাবরনে থাকা ধর্মীয় মৌলবাদীকে নোবেল পুরস্কার দেয়ায় এর মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকাগুলো প্রতিদিন তুলে ধরছে মিয়ানমারে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর হত্যা, ধর্ষন ও লুন্ঠনের ন্যাক্কারজনক প্রতিবেদন। মুখে ’অহিংস পরম ধর্ম’’ বুলি আওডালেও মিয়ানমারে বৌদ্ধ বিক্ষু নামধারী ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছে। ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চললেও কথিত মানবতাবাদী পশ্চিমা দেশগুলো এখন চুপ! সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হত্যায় মিয়ানমারের দোষ ধরছে না এরা। উল্টো বাংলাদেশকে আহবান জানাচ্ছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার।

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উপর গনহত্যা চালাচ্ছে এমন দাবী করেছেন যুক্তরাজ্যভিত্ত্বি একদল বিশেষজ্ঞ। আন্তর্জাতিক মানবাদিকার সংগঠন অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল বিবৃতিতে বলেছেন, মিয়ানমার সরকার দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলানদের সমষ্টিগত শাস্তি দিচ্ছে। এ আচরনকে নিষ্টুর বলেছে সংগঠনটি। কতিথ নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অং সান সুচির সরকার মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে গ্রামের পর গ্রামে তান্ডব চালাচ্ছেন সেনাবাহিনী। তাদের হামলার শিকার প্রতিটি গ্রাম প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গার বাড়িঘর জালিয়ে দেয়া হয়েছে। ধর্ষিত হয়েছে শত শত নারী। নিরপরাধ মানুষকে এরা পাখির মত গুলি করে মারছে।

শিশুদের জ্বলন্ত আগুনে ছুড়ে দিয়ে হত্যা করছে। দশ বছরের বেশি বয়সী ছেলেদের খুন করছে। স্বজনদের সামনেই জবাই করছে। অনেককে হাত পা কেটে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। প্রান নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বর্ননায় লোমহর্ষক চিত্র উঠে এসেছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনে অতিষ্ট আরও দশ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা রাখাইনের বিভিন্ন গ্রাম থেকে পালিয়ে সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছে। তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। এ লক্ষে মংডু থানার কুয়ারবিল এলাকার ঝোপ জঙ্গলে আত্বগোপন করে আছে। সুযোগ বুঝে তারা নাফ নদী পার হয়ে টেকনাফের ঝিলংখালী সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারীর মুখে অনুপ্রবেশের চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে বলে জানা গেছে। সুত্র মতে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় রাখাইনরা (মগ) ধর্ষণ, প্রকাশ্যে জবাই, শিশুদের আগুনে নিক্ষেপ, মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে অংশ নিচ্ছে। উখিয়ার কুতুপালং আনরেজিষ্টার্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ’রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে সেনাবাহিনী পেট্রল ঢেলে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করছে। সেখানে ধর্ষণের শিকার দেড়শ নারী উখিয়ার এক শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে।

জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা আতংকিত মানুষগুলো নিজ বাসভুমে ফিরতে চাচ্ছে না। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থানাধীন লুদাই গ্রামের মৃত ছালামত উল্লাহর ছেলে নুরুল কবিরের বর্ননায় উঠে এসেছে নৃশসংসতার নির্মম কাহিনী। ৩০ বছর বয়সী নুরুল কবির বলেন,’ তার ৫ বিঘা ধানী জমি ছিল। তা কেড়ে নেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। এরপর পবিরারের ১১ সদস্যের মধ্যে পুরুষরা আশ্রয় নেয় ঝোপঝাড়ের মধ্যে। মেয়েরা আশপাশের বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য ছুটোছুটি শুরু করে। এর মধ্যে তার ২৫ বছর বয়সী এক বোন হাসিনাকে ধরে নিয়ে যায় সেনারা। এরপর তাকে ধর্ষন করা হয়। একদিন পর হাসিনার রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়। কথা বলার সময় তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছিল। তিনি বলেন,’ আমার বোনটাকে ধর্ষনের পর হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি পাষন্ডরা।

তার ৩ বছরের ছেলে আফতাব এবং ৬ মাসের মেয়ে রেহেনাকে আগুনে ফেলে হত্যা করে তারা। বাকি ৭ বোন ও ভাইয়ের কোন খবর পাচ্ছি না। তারা বেঁেচ আছে কি না জানিনা। পুরো পরিবারটাকে নি:শেষ করে দিয়েছে তারা। এক সময় ভোটার তালিকায় তার নাম ছিল। কিছুদিন আগে তোমরা এ দেশের নাগরিক না বলেই নামটি কেটে দিয়েছে। মংডু থানাধীন নাইসাপ্রু গ্রামের মাহমুদ সেলিমের স্ত্রী ছেনুয়ারা বেগম ছোট-ছোট ৩ সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন কুতুপালং শিবিরে। তিনি বলেন,’ সে দেশের সেনাবাহিনী আমার স্বামীকে ডেকে নিয়ে জবাই করেছে। তার এ পরিনতি দেখতে হয়েছে আমাকে।

জীবনের নিরাপত্তার জন্য বাচ্চাদের নিয়ে বার্মার কুমারখালী সীমান্তে পৌছে এক দালালের মাধ্যমে পালিয়ে আসি। দীর্ঘ ২৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে এখানে আশ্রয় নিয়েছি। ছেনুয়ারা বলেন, তাদের বাড়ির আশপাশের কয়েকটি বাড়ির অনেক নারী ধর্ষনের শিকার হয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা মহিলাদের বুট জুতা দিয়ে বুকের উপর পা রেখে নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে। বাড়ির পাশের ছৈয়দ হোসেন, ধলু মিয়া ও গুরা মিয়াকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

মংডু নাইচং গ্রামের আবুল কাশেমের স্ত্রী ফাতেমা বেগম কুতুপালং শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি জানান, তার ভাই নুর মোহাম্মদ (৪০) এবং তার শ্বশুর আবদুর রহিমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এখানেই শেষ নয়। সেনারা নুর মোহাম্মদের ৪ বছরের কন্যা সন্তান সানজিদাকে হত্যার পর লাশটি আগুনে নিক্ষেপ করে। মোস্তফা মাঝির ছেলে রমজান আলী (৪০) স্ত্রী, সন্তান নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন,’ সে দেশের সেনাবাহিনী আমার ১৭ বছর বয়সী ছোট ভাই রফিককে জবাই করেছে। বাড়িঘুর পড়িয়ে দিয়েছে।

৪টি হালের বলদ ছিল তাও নিয়ে গেছে। ৬০ বছর বয়সী হামিদা খাতুন বলেন,’ তার মেয়ে ছমুদার স্বামী নুরুল ইসলামকে হত্যার পর লাশ টেনে রাস্তায় নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। লাশ দাফনের সুযোগও পাইনি। ২৫ বছর বয়সী শাহ আলম বলেন,’ ভাই রফিক ও বোন নুর জাহানকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ৫ ভাই ও পরিবারের স্বজনসহ ১৩ জনকে ধরে নিয়ে গেছে। বেঁচে আছে কিনা জানিনা। হামিদা খাতুন জানান, একই দিনে ১৪-১৫ জনকে জবাই করা হয়েছে। চেনাজানা ৩০টি মেয়েকে ধর্ষন করা হয়েছে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.