প্রশিক্ষিত জনশক্তির পথ উন্মোচনে হোক নির্দেশনা

0

খনরঞ্জন রায়::দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য দক্ষতা, জ্ঞান ও উদ্ভাবনী শক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে সকল দেশের শিক্ষা ও দক্ষতা উচ্চমানের সেই সকল দেশ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অনেক বেশি কার্যকর। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য প্রথমে দরকার উচ্চমানের দক্ষ জনশক্তি। সেই ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে ডিপ্লোমা শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশী এসএসসি’র পর একজন শিক্ষার্থী ক্যারিয়ার হিসাবে ডিপ্লোমা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। যাতে ডিপ্লোমা শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি ২০২১ সালে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে স্বীকৃতি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে।

ডিপ্লোমা শিক্ষা গ্রহণের পর শিক্ষার্থীকে আর চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। সে নিজেই শিক্ষার সাথে মিল রেখে স্বাধীনভাবে পেশা খুঁজে নিতে পারে। সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে সেটা সহজলভ্য নয়। অন্যদিকে ডিপ্লোমা শিক্ষা দিতে পারে নিরাপদ কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। পৃথিবীর যে দেশ যত বেশি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পেরেছে তারা তত বেশি উন্নতি লাভ করেছে। আমাদের রয়েছে বিপুল জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে পরিণত করতে পারলে দেশের অগ্রগতি হবে অপ্রতিরোধ্য।

স্বাধীনতার ঊর্ষা লগ্ন থেকে প্রতিদিন প্রতিরাত, রাতদিন ২৪ ঘন্টায় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় স্পীকার, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, সম্মানিত সচিববৃন্দ, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, নিু পর্যায়ে উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবক বক্তৃতা, বিবৃতি, টকশো’তে এবং সংবাদপত্রে নিবন্ধ লিখে ডিপ্লোমা শিক্ষার গুরুত্ব ও মহত্ব প্রকাশ করে যাচ্ছেন।

সরকারি আধাসরকারি এনজিও মাধ্যমে প্রতিদিন শত-শত সভা সেমিনার, সম্মেলন, ওয়ার্কশপ আয়োজন করে কারি কারি অর্থ অপচয় করা হচ্ছে। এর আবেদন আকাক্সক্ষায় একদিনের প্রকাশিত সংবাদগুলো নিয়ে কোন গবেষক একটি ‘মহাগ্রন্থ’ সংকলন করতে পারেন। তাতে কি হয়েছে? ডিপ্লোমা শিক্ষার প্রসার নূন্যতম বৃদ্ধি পায়নি। শিক্ষার্থীদের নাড়া দেয়নি। অভিভাবকদের ডিপ্লোমা শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহবোধ জাগানো যায়নি।

২০১৬ সালের এইচএসসিতে ভর্তির আবেদন থেকে শিক্ষিত বনাম সুশিক্ষিত দ্বন্দ্বে ভুগছে জাতি। যেখানে ৮টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড নিয়ন্ত্রিত ৯ হাজার ১৩৩ টি কলেজে ২১ লাখ ১৪ হাজার ২৫৬ টি আসন সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ ডিপ্লোমা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী ৭টি প্রতিষ্ঠান সবমিলিয়ে এক হাজার দুইশত ইনস্টিটিউটে ১ লাখ ৪১২টি আসন সৃষ্টি করেছে। অথচ সার্কভূক্ত দেশগুলো এবং বাংলাদেশের ভৌগলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী বিবেচনা করা হলে ১২ হাজার ইনস্টিটিউটে ৭ লক্ষ আসন বিশিষ্ট ডিপ্লোমা শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল।

উপনিবেশিক আমলে গড়া ডিপ্লোমা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী ৭টি প্রতিষ্ঠান যথা কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, আয়ুর্বেদীয় বোর্ড, হোমিওপ্যাথিক বোর্ড, নার্সিং কাউন্সিল, রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমিগুলোর ব্যর্থতা জাতি চড়া মূল্য দিচ্ছে। আজকে অর্ধকোটি শিক্ষিত বেকার যুবকের বোঝা বহন করছে দেশ। অন্যদিকে প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে প্রতিষ্ঠিত শিল্পগুলো একে একে বন্ধ হচ্ছে। নতুন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। হলেও দক্ষ জনশক্তি বিদেশ থেকে আমদানি করছে। বছরে ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশ যাচ্ছে শুধু দক্ষতার পিছনে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে ভুল চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে।

বিদেশেও দক্ষ জনশক্তি প্রেরণ করা যাচ্ছে না। আয়া, বুয়া, বয়, হেলপার, পাঠিয়ে দেশের সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি দ্রুত সংস্কারের প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সনাতন শিক্ষাপদ্ধতি একবিংশ শতাব্দীর জন্য উপযুক্ত কর্মীবাহিনী তৈরি করতে পারছে না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কর্মজীবনে কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে পারছেন না। মানসম্মত ও যুগোপযোগী ডিপ্লোমা শিক্ষার এই দিগন্ত উন্মোচন করতে পারলে শ্রমবাজারের চাহিদাপূরণ করতে পারার মতো একটি প্রশিক্ষিত, দক্ষ এবং কর্মঠ জনশক্তি গড়ে ওঠবে। বৈশ্বিক শ্রমবাজারের প্রকৃতি ও চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন নতুন ডিপ্লোমা কোর্স চালু করতে পারে।

দেশের বিপুল যুব শক্তিকে কাক্সিক্ষত শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে হলে উপনিবেশিক চেতনায় গড়া ডিপ্লোমা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রাম ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, খুলনা ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, রাজশাহী ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, সিলেট ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, বরিশাল ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, রংপুর ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, ময়মনসিংহ ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ বছরেই উদ্যোগ নিন। আর একটা নির্দেশনা দিন, যেন কলেজ শিক্ষায় পরগাছা না হয়ে ডিপ্লোমা শিক্ষায় সম্পৃক্ত হয়। এক্ষেত্রে কলেজ ভর্তির জন্য নূন্যতম জিপিএ গ্রেড নির্ধারণ করা যেতে পারে। জিপিএ ৪ থেকে উপরের দিকে কলেজ আর তার থেকে নিুগামীরা হবে ডিপ্লোমার ছাত্র। তা না হলে ডিপ্লোমার আসন বার বার বিজ্ঞপ্তিতেও শূন্য পরে থাকবে। নিজেকে সমৃদ্ধ করার শিক্ষা থেকে পরগাছা হওয়ার অবাস্তব শিক্ষায় ধাবিত হবে। যেমনটা গত ৪৫ বছরে হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে এরকম নির্দেশনা জারির সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। আসুন না আমরা উদ্যাপন করি সরকারের দায়িত্ববোধের সেই কাঙ্ক্ষিত নির্দেশনাটি।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.