অপহরণের দু’বছর পর সন্তানের মৃত্যুর খবর পেল বাবা-মা

0

কামরুল ইসলাম দুলু, সীতাকুণ্ড:: চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড উপজেলাধীন ভাটিয়ারী ইউনিয়নের মাদাম বিবির হাট শাহজাহান উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর ছাত্র আবদুল মোতালেব ওরফে সাগর ওরফে রাসেল ২০১৩ ইং সনের ২৫ শে নভেম্বর বাংলা ২য় পত্রের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে তার নিজ বাড়ী ভাটিয়ারী রেল ষ্টেশনের পূর্ব পার্শ্বে পূর্ব হাসনাবাদ গ্রামে যাবার পর বিকেলে অপহৃত হয়।

তার পিতার নাম মোঃ আকবর এবং মাতার নাম নাসিমা বেগম। তাদের ২ সন্তানের মধ্যে সাগর (১৪) বড়। সন্দ্বীপ থানার মগধারা গ্রামে তাদের আদি নিবাস হলেও গত ১৮ বছর যাবত তারা ভাটিয়ারীতে নিজস্ব বাড়ীতে বসবাস করে আসছে। ঘটনার দিন ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ায় প্রশাসন আইন শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত ছিল। তাই দুবৃর্ত্তরা এ দিনে তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক সাগরকে অপহরণ করে।

সন্ধ্যায় সাগর তাদের বাসায় ফিরে না আসলে সাগরের বাবা সীতাকুন্ড থানায় ১০৭২ নম্বরের ১টি নিখোঁজ ডায়রী করেন। রাতে অপহরণকারীরা সাগরের বাবার ০১৭১৯-৫৬১০৮৩ মোবাইল নম্বরে ফোন করে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপন দাবী করে। ০৩/১২/২০১৩ ইং তারিখে অপহরণকারীরা ১ লাখ টাকা মুক্তিপনে সাগরকে ছেড়ে দিতে মোবাইলে রাজী হলে ঐ দিনই রাত ৯ টায় নাসিরাবাদ পলিটেকনিকের সামনে অপহরণকারীদেরকে ১ লাখ টাকা দেয়া হলেও তারা টাকা নিয়ে সাগরকে মুক্তি দেয়নি। অপহরণকারীদের মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে কৌশলে হোসাইন নামের একজন অপহরনকারীকে ৭/২/২০১৪ ইং তারিখ বিকেলে ভাটিয়ারীর ছোয়াখালী লঞ্চঘাট হতে সাগরের আত্মীয় স্বজন ও এলাকাবাসী আটক করে ভাটিয়ারী ইউ পি কার্যালয়ে নিয়ে আসে।

খুনি-  নাঞ্জমুল,আকিব,নবী
খুনি- নাঞ্জমুল,আকিব,নবী

সে তার সাথে অপহরনের কাজে পূর্ব হাসনাবাদ গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন প্রকাশ দুলালের ছেলে নাজমুল হোসেন (২১) ও মোহাম্মদ নাছিরের ছেলে নুরুল ইসলাম রাজু (১৬) গনের নাম প্রকাশ করে এবং তাকে সীতাকুন্ড থানায় সোপর্দ্দ করার পর থানায় ৬(২)১৪ নং মামলা রেকর্ড করে। পুলিশ নুরুল ইসলাম রাজুকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে আনলে রাজু একই এলাকার মৃত শাহজানের পুত্র সাহাবুদ্দীন (২৫), মোঃ জাফর প্রকাশ জহুরের পুত্র নবী (২২), মোঃ সফিক প্রকাশ সফির পুত্র ওমর ফারুক (১৭) ও জনৈক মনির অপহরনের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। নবী ও নাজমুল পালিয়ে যায়। পুলিশ বাকীদেরকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরও অপহৃত সাগরের কোন সন্ধান মিলেনি। ১৭/০৪/২০১৪ ইং তারিখে মামলাটি সি আই ডিতে হস্তান্তর করা হলে ইন্সপেক্টর মিতশ্রী বড়ুয়াকে মামলার তদন্ত ভার দেয়া হয়। তিনিও আসামীদেরকে রিমান্ডে এনে সাগরের কোন সন্ধান লাভ করতে পারেননি। এ দিকে সাগরের মা-বাবা সাগরকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়েছে। তারা কোন সময় খবর পান যে, অপহরনকারীরা সাগরকে কাপ্তাইয়ের পাহাড়ী এলাকায় মদের কারখানায় শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, সেখানে তারা পুলিশ নিয়ে অভিযান চালালেও সাগরকে পাওয়া যায়নি।

আবার কোন সময় খবর আসে যে, সাগর বান্দরবানে উপজাতীয়দের কাছে আটক রয়েছে সেখানেও তল্লাসী করে পাওয়া যায়নি। এরপর বৈদ্য, সাধু, দরবেশ হাজিরা দেখা ইত্যাদি এমনকি যে যেভাবে, যেখানে বলেছে তারা তাই করেছে, লাখ লাখ টাকা খরচ করেছে, আশ্বাস পেয়েছে, সাগর জীবিত আছে। একদিন মা-বাবার কাছে ফিরে আসবে। সি আই ডি ২৯/০১/২০১৫ ইং তারিখে নারী-শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল-২ আদালতের ৭১৭/১৪ নং মামলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত-২০০৩) এর ৭,৮,৩০ ধারা মতে ২৪ ও ২৪ (ক) নং অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। ধৃত কয়েকজন আসামী জামিন পেয়েছে। বিচারকার্য চলছে। এমতবস্থায় মাস খানেক আগে ২৮/১০/২০১৫ ইং তারিখে সি আই ডি ইন্সপেক্টর জনাব মনজুর কাদের মজুমদার সংবাদ পান যে, সাগরের হত্যাকারী চন্দনাইশ থানার খন্দকার পাড়ার আবু বকরের ছেলে মোঃ আকিব(২৭) চন্দনাইশ থানায় আত্মসমর্পন করেছে। তিনি ঐ দিনই চন্দনাইশ থানা হতে মোঃ আকিবকে এনে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ফারহানা ইয়াসমিন এর নিকট ২৯/১০/২০১৫ইং তারিখ উপস্থিত করালে ম্যাজিষ্ট্রেটের খাসকামড়ায় ১৬৪ ধারা মতে আকিবের স্বেচছায় জবান বন্দি গ্রহণ করা হয়।

জবানবন্দিতে মোঃ আকিব জানায় যে দিন অর্থাৎ ২৫/১১/২০১৩ ইং তারিখে সাগরকে অপহরণ করা হয়েছিল সে দিনই রাতে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সাগর ধনী লোকের ছেলে ভেবে, মোটা অংকের মুক্তিপনের টাকা পাওয়া যাবে এ আশায় সাগরকে অপহরণ করা হয়েছিল। কিন্তু সাগরকে জিজ্ঞাসাবাদে যখন তারা জানতে পারে যে, তার বাবা একজন রাজ মিস্ত্রী কন্ট্রাক্টর, সুতরাং তাদের চাহিদামত মুক্তিপনের টাকা পাওয়া যাবে না এবং তাকে ছেড়ে দিলে সে স্থানীয় অপহরণকারীদের নাম বলে দিবে তাই অপহরণকারীরা সাগরকে চন্দনাইশ থানার বরকলের ১টি ধান ক্ষেতে নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে। এ হত্যাকান্ডে আকিব, রিটন কন্ট্রাক্টর, খায়রুজ্জমান হিরু, নবী, রাজু ও নাজমুল অংশ নেয়।

সাগরকে ধান ক্ষেতের কাদা মাটিতে ফেলে নবী সাগরের গলায় পা দিয়ে চিবে ধরে। এতে সাগর মারা না গেলে ১টি কাঠ দিয়া সাগরের মাথায় আঘাত করে তাহার মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং তাকে কেউ যেন চিনতে না পারে সে জন্য তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরের দিন চন্দনাইশ থানার পুলিশ সগারের লাশকে অজ্ঞাত লাশ হিসেবে মর্গে পাঠায় এবং আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম চট্টগ্রাম ষ্টেশন রোডস্থ চৈতন্য গলিতে ৮০২ নম্বর কবরে সাগরকে দাফন করা হয়। খুনী আকিবের এ জবানবন্দির মাধ্যমে সাগরের মা-বাবা ২ বছর পর জানতে পারে তাদের আদরের ছেলে সাগর আর জীবিত নেই। সাগর হত্যাকারী নবী, আকিব, সাহাবুদ্দীন, রাজু, নাজমুল, ফারুক, রিটন, খায়রুজ্জমান হিরু, মনির ও হোসাইনের ফাঁসি দাবি করছে তার পরিবার। সিলেটের শিশু রাজন, খুলনার রাকিব হত্যার বিচার যেভাবে বিশেষ ট্রাইবুনালে হয়েছে তদ্রুপ সীতাকুন্ডের স্কুল ছাত্র সাগর হত্যাকারীদের বিচারও বিশেষ ট্রাইবুনালে সম্পন্ন করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবী জানান সাগরের পরিবার।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.