খাগড়াছড়ির মাটিরাঙার ১১টি অবৈধ ইট ভাটা

0

শ্যামল রুদ্র,রামগড়(খাগড়াছড়ি) : খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা উপজেলায় জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া অবৈধ ভাবে এগারটি ইটভাটা গড়ে উঠার খবর পাওয়া গেছে। এ সব ভাটায় পাহাড় ও ধানি জমির মাটি এবং কয়লার পরিবর্তে চারা গাছ জ্বালিয়ে ইট তৈরির অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন,ইট পোড়ানোর মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপক ভাবে চারা গাছ নিধনের মহোৎসব চলছে এলাকায়।

জানা যায়,উপজেলা প্রশাসনের কর্তাব্যাক্তিসহ বিভিন্ন সংস্থাকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে ভাটা মালিকরা এ অবৈধ ব্যবসা চালাচ্ছেন। যে কারণে কোনো অবস্থাতেই তাঁদের প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। ইট পোড়ানোর শুরুর দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ভাটাগুলোয় অভিযান চালান। যা এলাকাবাসীর কাছে প্রশাসনের আই ওয়াশ হিসাবে পরিচিত ! কেননা তারপর পুরো বছর জুড়ে তাঁদের আর কোনো তৎপরতা নজরে আসে না। অবশ্য এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষন করে মাটিরাঙার ইউএনও শহিদ মোহাম্মদ সাইদুল হক বলেন, বেআইনী কাজ থেকে বিরত রাখতে স্থানীয় প্রশাসন সবসময় তৎপর।

ইউএনও বলেন, পার্বত্য চট্রগ্রামে নতুন ভাটায় ইট তৈরী করে ব্যবসা করার বিষয়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু আমরা বিশেষ বিবেচনায় পুরোনো ভাটায় সরকারি নিয়ম মেনে এবং সীমিত পরিসরে ইট তৈরির অনুমতি দিই। কারণ জেলায় নানা উন্নয়ন মূলক অবকাঠামো নির্মাণে প্রচুর ইট প্রয়োজন হয়। কিন্তু আইনি শিথিলতার এই সুযোগে কোনো কোনো অসাধু ভাটা মালিক পাহাড় ও ধানি জমি কেটে মাটি সংগ্রহ এবং চারা গাছ পোড়ানো সহ নানা অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়েন। তাই মাঝে মাঝে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করা হয়। পুরো ইট পোড়ানো মৌসুমেই এ ভাবে বেআইনি কাজের তদারকিতে উপজেলা প্রশাসন সক্রিয় আছেন বলে তিনি দাবী করেন।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্রে জানা যায়, নির্বিঘেœ ব্যবসা চালাতে বিভিন্ন জায়গায় পয়সা দিতে হয় ভাটা মালিকদের। এর মধ্যে রয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), (মাসে প্রতি ভাটা ৪০ হাজার টাকা) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), (মাসে প্রতিভাটা ৩০ হাজার টাকা) স্থানীয় বন বিভাগ, (প্রতিভাটা এক কালীন ত্রিশ হাজার টাকা) আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ, (প্রতি ভাটা এককালীন ষাট হাজার টাকা) আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস (এমএন গ্র“প), (প্রতি ভাটা এককালীন চল্লিশ হাজার টাকা) দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল, (আওয়ামীলীগ) এবং বিভিন্ন গোয়েন্দো সংস্থা ও সাংবাদিকদের নামে মোটা অংকের অর্থ আদায় করা হয়। এর বাইরে জেলার কর্মকর্তাদের ম্যানেজ রাখতে প্রত্যেক ভাটা বাবদ এক লাখ টাকা করে জেলা ভাটা মালিক সমিতিতে জমা দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে মাটিরাঙার ভাটা মালিক হাবিবুর রহমান বলেন, ব্যবসা করে যদি লাভ হয় তাহলে পয়সা দিতে ক্ষতি কোথায়! আর অবৈধ লেনদেনের বিষয়টি এখন অনেকটাই খোলামেলা। তিনি জানান,মাটিরাঙার এগারটি ইটভাটার সব কয়টিই অবৈধ।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়,উপজেলার সব কয়টি ভাটাতেই গাছ জ্বালিয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া মাটিরাঙার ওয়াচু মৌজায় “সেলিম ব্রিকস” এবং হাফছড়ি ইউনিয়নের জালিয়াপাড়ায় “ফোর স্টার ব্রিকস” এই দু’টি ভাটাই পাহাড় কেটে বনের ভেতর তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে “ফোর ষ্টার ব্রিকস” নামের ইট ভাটাটি নতুন। এ বিষয়ে তাঁর (ইউএনও’র) দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে তিনি বলেন, “ফোর স্টার ব্রিকস” কে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। “সেলিম ব্রিকস” এর বিষয়েও খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি তাঁরাও পাহাড় কেটেছেন। তাই শিগগিরই সরেজমিন গিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।

এদিকে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক (ডিসি) মাসুদ করিম সাংবাদিকদের বলেছেন, খাগড়াছড়ি জেলার সবগুলো ইটভাটাই অবৈধ। একটিরও পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের কোন বৈধ ছাড়পত্র নেই। তাই এ গুলো বন্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া আছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মনজুর মোরশেদ ও হাফছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উষাপ্র“ মারমা বলেন, অবৈধ এ সব ইট ভাটায় ব্যাপক ভাবে বনের চারা গাছ পুড়িয়ে জেলার বনভূমি প্রায় ধংস করে ফেলছে। পাশা পাশা ধানি জমির মাটি ও পাহাড় কেটে ভাটায় ব্যবহার করায় এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ এখন মারাত্বক হুমকীর মুখে। এ অশুভ কর্মকান্ড বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনের সত্যিকারের আইনী পদক্ষেপ দাবি করেছেন তাঁরা। তাঁরা অভিযোগ করে বলেন, বছরের শুরুতে ভাটা গুলোয় লোক দেখানো কিছু জরিমানা করা হলেও সারা বছরই স্থানীয় প্রশাসন অজ্ঞাত কারণে নিশ্চুপ থাকেন। ইট ভাটাকে কেন্দ্র করে অবৈধ লেনদেনের বিষয়টিও তারা শুনেছেন বলে এই প্রতিনিধিকে জানান।

জেলা প্রশাসকের বক্তব্য প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ি জেলা ইট ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মো.মুজিবুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ডিসি স্যার হচ্ছেন পুরো জেলার মালিক। তাঁর অনেক ক্ষমতা, তিনি অনেক কিছুই বলতে পারেন। তবে এটা ঠিক পার্বত্য চট্রগ্রামে ইট ভাটা তৈরিতে সরকারি অনুমোদন নেই কিন্তু পাশাপশি মনে রাখতে হবে আমরা প্রতিবছর প্রত্যেকটি ইট ভাটার জন্য ভ্যাট বা মূসক (মূল্য সংযোজন কর) বাবদ ২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিই। এর বাইরে জমির উন্নয়ন কর, পৌর কর ও ট্রেড লাইসেন্সসহ আরও কয়েকটি খাত মিলিয়ে মোটা অংকের একটা অর্থ সরকারি রাজস্ব খাতে জমা দিয়েই ব্যবসা করছি। আমরা সরকারকে আয়করও দিই।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.